কোন দেশে কত রোহিঙ্গার বসবাস

---
বিশ্বের অন্যতম নিপীড়িত জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকারের তাণ্ডব নতুন নয়। ১৭৮৪ সালে বার্মার তৎকালীন রাজা আরাকান দখলের পর থেকে নতুন আঙ্গিকে এ জনগোষ্ঠীর মানুষের দীর্ঘ ভাগ্য বিড়ম্বনার শুরু। চলতি বছরের ২৪ আগস্ট রাখাইন রাজ্যের ২৪টি পুলিশ চেকপোস্টে হামলার পর রোহিঙ্গাদের ওপর নতুন করে নির্বিচারে জাতিগত নিধনযজ্ঞ শুরু করে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় দেশটির উগ্রপন্থী বৌদ্ধরাও। নির্বিচারে খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ থেকে বাঁচতে এরইমধ্যে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন বহু রোহিঙ্গা। জাতিসংঘের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন তিন লাখ ১৩ হাজার রোহিঙ্গা। তবে ধারণা করা হচ্ছে, তাদের প্রবেশের প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে আরও অনেক বেশি। ১৯৭০ সালে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয় বার্মিজ কর্তৃপক্ষ। নতুন মাত্রা পায় রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন। সেই থেকে এ পর্যন্ত জীবন বাঁচাতে দেশটি ছেড়ে পালিয়েছেন প্রায় ১০ লাখ মানুষ। দেখে নেওয়া যাক বিশ্বের কোন দেশে কত রোহিঙ্গা এ মুহূর্তে বসবাস করছেন।
বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের সংখ্যা:
মিয়ানমার ১০ লাখ, বাংলাদেশ ৭ লাখ ৩১ হাজার, পাকিস্তান ৩ লাখ ৫০ হাজার, সৌদি আরব ২ লাখ, মালয়েশিয়া ১ লাখ ৫০ হাজার, ভারত ৪০ হাজার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ১০ হাজার, থাইল্যান্ড ৫ হাজার, ইন্দোনেশিয়া ১ হাজার।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, রোহিঙ্গারা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত ও রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠী। ঐতিহাসিকভাবে রোহিঙ্গারা আরাকান বা রাখাইনের হাজার বছরের পুরনো জনগোষ্ঠী। ১০৪৪ সালে আরাকান রাজ্য দখলদার কট্টর বৌদ্ধ বর্মী রাজা ‘আনাওহতা’ মগদের বার্মা থেকে রোহিঙ্গাদের দক্ষিণাঞ্চলে বিতাড়িত করে বৌদ্ধ বসতি স্থাপন করান।
রাখাইনে দুটি সম্প্রদায়ের বসবাস। দক্ষিণে ‘মগ’ ও উত্তরে ‘রোহিঙ্গা’। মগরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মগের মুল্লুক কথাটি বাংলাদেশে পরিচিত। দস্যুবৃত্তির কারণেই এমন নাম হয়েছে ‘মগ’দের। একসময় তাদের দৌরাত্ম্য ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। মোগলরা তাদের তাড়া করে জঙ্গলে ফেরত পাঠায়।
১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের আরাকান স্বাধীন রাজ্য ছিল। মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখল করার পর চরম বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়। এক সময়ে ব্রিটিশদের দখলে যায় পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হয়। সে সময়ে পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এ জনগোষ্ঠীর কয়েকজন পদস্থ সরকারি দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে মিয়ানমারের যাত্রাপথ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। রোহিঙ্গাদের জন্য শুরু হয় দুর্ভোগের নতুন অধ্যায়। সামরিক জান্তা তাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। নামাজ আদায়ে বাধা দেওয়া হয়। খুন-ধর্ষণ হয়ে পড়ে নিয়মিত ঘটনা। জোর করে সহায়-সম্পদ কেড়ে নেওয়া হয়। বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হতে থাকে। বর্তমান মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের শিক্ষা গ্রহণেরও সুযোগ নেই। রোহিঙ্গা জনসংখ্যা যাতে না বাড়ে, সে জন্য বিয়ে ও সন্তান গ্রহণের মতো বিষয়েও তাদের ওপর একের পর এক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডের অনেকের কাছেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ‘কালা’ নামে পরিচিত। বাঙালিদেরও তারা ‘কালা’ বলে। সেখানে ভারতীয়রাও একইভাবে পরিচিতি। এই ‘কালা’ শব্দটি সেখানে সীমাহীন ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। একদিকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, অন্যদিকে উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের তাণ্ডব! এমন বাস্তবতায় বহু বছর ধরেই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দেশান্তরী হচ্ছেন রোহিঙ্গারা। একারণে প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় সবচেয়ে বড় ধকলটি যাচ্ছে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে।