পতিতার দালালের অভিশপ্ত জীবন
---
যখন বুঝলাম, তখন সব শেষ। জীবন সায়াহ্নে এসে এখন একাকিত্ব জীবন। স্ত্রী-সন্তান কেউ আমায় ডাকে না। কেউ আমাকে আদর করে কাছে টানে না। ভাইবোন সবাই দুর দুর করে তাড়িয়ে দেয়। নির্ঘুম রাত কাটাই। চিন্তা করি, এটাই আমার জীবনে পাওয়া ছিল। এটাই আমার শাস্তি। এর চেয়ে বড় শাস্তি এলেও মাথা পেতে নেবো। কারণ আমি জীবনের ছত্রিশটি বছর কোনো ভালো কাজ করিনি। কত মেয়ের জীবনকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছি এর হিসাব নেই। আমার হাত ধরে পতিতার খাতায় নাম লিখিয়েছে এমন অনেক নাম আমার জানা। এক নামে আমাকে পতিতার দালাল হিসেবে চিনে রাজধানীর আবাসিক হোটেল মালিকরা। পুলিশের খাতায়ও আমার নাম আছে। তফা বললে সবাই চেনে আমায়। আশির দশকের শুরুতে ঢাকায় আসি। কোথাও কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। স্থান হয় গুলিস্তান। রাতে সেখানেই থাকি। এখন যেখানে নাট্যমঞ্চ হয়েছে সে জায়গায় একটি পুকুর ছিল। ওই পুকুরে গোসল করতাম। এর পাশে ঝুপড়ি ঘরে থাকতাম। এভাবে ক’দিন যাওয়ার পর কাপ্তান বাজারের পাশেই একটি আবাসিক হোটেলে বয়ের কাজ পাই। রাতে কাস্টমাররা আসেন। তাদের সেবা-যত্ন করাই আমার কাজ। ক’দিন যেতে না যেতেই বুঝতে পারি সেবার মধ্যে মেয়ে সাপ্লাইও দিতে হয়। আর এ জন্য হোটেলের কিছু নির্দিষ্ট পতিতা রয়েছে। তবে নতুন নতুন মেয়ে হলে কাস্টমার খুশি হয়। এ কারণে নতুন মেয়ে খুঁজতে হতো। ঢাকায় তখন অনেক মেয়ে আসতো কাজের সন্ধানে। তাদের কাউকে পটিয়ে, কাউকে বুঝিয়ে, কাউকে জোর করে হোটেলে নিয়ে যাওয়া হতো। আবার কেউ কেউ ইচ্ছা করেই আসতো। রাত নেই, দিন নেই কাস্টমারের বিছানায় ঠেলে দেয়া হতো তাদের। এতে ওরাও টাকা পেতো। আমিও পেতাম। হোটেল মালিক তো পেতোই। এভাবেই চলছিল জীবন। কখনো পুরান ঢাকা, কখনো মগবাজার, কখনো কাওরান বাজার, কখনওবা সেগুনবাগিচার হোটেলে কাজ করি। ক’বছর যেতে না যেতেই সবার কাছে পরিচিত হয়ে উঠি। আমার মতো এমন পতিতার দালাল ঢাকার হোটেলগুলোতে অনেক আছে। পতিতার দালালি করতে করতেই এক পতিতাকে বিয়ে করে ফেলি। বিয়ের পর আর তাকে ওই কাজে পাঠাইনি। এখন আমার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। তারা বড় হয়েছে। কয়েক বছর ঢাকায় রাখার পর তাদের শ্বশুরবাড়ি কিশোরগঞ্জ পাঠিয়ে দেই। আমার ছায়া যেন আমার সন্তানদের উপর না পড়ে সে চিন্তায় তাদের দূরে ঠেলে দেই। সপ্তাহে-দু’সপ্তাহে একবার বাড়ি যাই। স্ত্রী-সন্তানকে সময় দেই। পতিতাকে ভালোবেসে বিয়ে করার কাহিনী বলতে গিয়ে তফা বলেন, ও সবেমাত্র এ লাইনে পা দিয়েছে। ঢাকায় এসেছিল কাজের সন্ধানে। কিন্তু আমার ফাঁদে পড়ে পতিতার খাতায় নাম লেখায়। ও যেদিন সতীত্ব হারায় আমি দেখেছি ওর কান্না। ওর চিৎকারে মনে হয়েছিল আকাশ-বাতাস পর্যন্ত কাঁদছিল। আমি সহ্য করতে পারিনি। ওর হাত ধরে নিয়ে যাই কাজী অফিসে। সেখানে বিয়ে করি। তারপর বাসাভাড়া নেই বাড্ডা এলাকায়। প্রথম সন্তান হওয়ার পরই ওকে আর ঢাকায় রাখিনি। কিশোরগঞ্জ পাঠিয়ে দেই। সত্যি বলতে কি-একবার যারা এ পথে পা বাড়ায় তারা আর ফিরে যেতে পারে না। তাদের ভয়, সতীত্বহারা জীবন নিয়ে কোথায় যাবে? কে তাদের
বিয়ে করবে? আশ্রয় দেবে? এসব ভেবে জীবনটাই পার করে দেয়। তফা জানায়, পতিতার দালালি করতে গিয়ে থানা পুলিশের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। তাদের ম্যানেজ করে কাজ করতে হয়। মাঝে মধ্যে অভিযানও চলে। এমন অভিযানে একাধিকবার গ্রেপ্তারও হয়েছি। আবার আমাদের নিজেদের লোকই জামিনে বের করে এনেছে। এখন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রোগ। স্ত্রী-সন্তান আর এখন আশ্রয় দেয় না। তাই বাধ্য হয়ে এখানে ওখানে রাত কাটাই। তবে পতিতার দালালি পেশা ছেড়ে দিয়েছি দুই বছর আগে। এখন ঘুম হয় না। দুই চোখ এক হলেই দেখি হাজারও মেয়ের কণ্ঠ আমাকে অভিশাপ দিচ্ছে। বলছে, আমাদের মূল্যবান সম্পদ সতীত্ব তুই বিকিয়ে দিয়েছিস। তোর ক্ষমা নেই। দিন-রাত এভাবেই পার হচ্ছে। এসব থেকে পালাতে নিজ গ্রামে ছুটে যাই। ভাইবোন সবাই আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমার জীবনটাই আসলে বৃথা। দালালি জীবনের স্মরণীয় কথা বলতে গিয়ে জানান, সেদিন ছিল ১৯৯৮ সালের এপ্রিল মাস। সন্ধ্যার পর মগবাজারের এক হোটেলে রেইড দেয় পুলিশ। ১৮ জন পতিতাকে গ্রেপ্তার করে। ছিল বেশ ক’জন দালালও। তাদের নেয়া হয় আদালতে। এরমধ্যে একজনকে মিরপুর ভবঘুরে কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেই মেয়েটি ছিল আমার পূর্ব পরিচিত। তাকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মুক্ত করি। এরপর তাকেও বিয়ে করি। কিন্তু বছর কয়েক সংসার করার পর ওর সঙ্গে বনিবনা হয়নি। তাকে ছেড়ে দেই। পতিতার দালালি করতে গিয়ে অনেক পাপ করেছি। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করছি এখন। নিজের সন্তানের মুখ দেখতে পাই না। এরচেয়ে বড় কষ্ট জীবনে আর কি আছে। আমার এই অভিশপ্ত জীবন দ্রুত যেন শেষ হয় সবার কাছে এ দোয়াই করি। আরেক পতিতার দালাল কালা মিয়া। কাওরান বাজারের হোটেলগুলোতে পতিতা সাপ্লাই দেয়। কালা মিয়া জানায়, জানি এ কাজ পাপের। কিন্তু কি করবো বলুন। আর কোনো কাজ যে শিখিনি। কেউ যে আমাদের কাজ দেয় না। পতিতা সাপ্লাই দিয়ে যেমন অর্থ উপার্জন করি, দুই হাতে তা খরচও করি। গ্রামের লোকজন জানে আমি ঢাকায় ভালো চাকরি করি। তবে এ পথে আসা মেয়েদের জীবন বড় কষ্টের। মেয়েদের জীবনে সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো তাদের ইজ্জত। কোন্ পরিস্থিতিতে পড়লে তারা সেই ইজ্জত বিক্রি করেন একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন। তাদের প্রত্যেকের জীবনেই আছে কষ্টের গল্প। অসুখের গল্প। নির্যাতনের গল্প। নিপীড়নের গল্প। তাদের সঙ্গে কথা বললেই বুঝতে পারবেন কেন ওরা এ পথে পা বাড়িয়েছে। হ্যাঁ কাউকে কাউকে হয়তো ব্ল্যাকমেইল করে আনা হয়েছে এ পথে। কিন্তু কেউ তো এ পথ থেকে দূরে সরে যায়নি। কালা মিয়া বলেন, জানি এ কাজ মহাপাপের। আর এ পাপের প্রায়শ্চিত্তও আমাকে করতে হবে। তারপরও ভাবি এছাড়া যে, আমার কোনো পথ খোলা নেই। গত সপ্তাহে মগবাজারে এক হোটেলে পতিতা সাপ্লাই দিতে গিয়ে আনার নামের এক দালাল গ্রেপ্তার হয় ঝিগাতলা এলাকার এক হোটেল থেকে। সারারাত সে ছিল হাজারীবাগ থানায়। পরদিন তাকে আদালতে নেয়া হয়। সেদিন ঝিগাতলার সে হোটেল থেকে সাত পতিতাসহ ৭ দালালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এভাবে প্রায়ই রাজধানীর হোটেলগুলোতে অভিযান চালানো হয়। গ্রেপ্তারও করা হয়। হাজারীবাগ থানার ওসি মীর আলিমুজ্জামান বলেন, এসব মামলায় গ্রেপ্তার করলে সর্বোচ্চ ২০ থেকে ২৫ দিন জেল খেটে ওরা জামিনে বেরিয়ে আসে। ফের আগের কাজে ফিরে যায়। একজন হোটেল মালিক বলেন, কাস্টমারের চাহিদা পূরণের জন্যই পতিতা রাখা হয়। এতে ব্যবসা ভালো হয়। ব্যবসার প্রয়োজনেই আমাদের এ পথ অবলম্বন করতে হয়। পতিতার দালাল তফার শেষ কথা-জীবনে কেউ এ পথে নামবেন না। আমার মতো অভিশপ্ত জীবন ডেকে আনবেন না। দোহাই আপনাদের, এর ফল যে খারাপ এখন আমি হাড়ে হাড়ে তা টের পাচ্ছি। মানবজমিন