মোদী-কেজরিওয়াল ‘সরাসরি লড়াই’ শুরু
---
আন্তর্জাতিক ডেস্ক :সাম্প্রতিক সব নির্বাচনে বিপুল সাফল্যের পরও দিল্লিতে শান্তি নেই বিজেপির। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আক্রমণ করেই চলেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। কিছু আক্রমণের ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও বিনা যুদ্ধে ‘সূচ্যগ্র মেদিনী’ ছাড়তে নারাজ তিনি। সেই যুদ্ধের হালহকিকত জানার আগে একটু পেছনে ফেরা যাক।
সেই ২০১০-১১ সালে ‘ইন্ডিয়া এগেনস্ট করাপশন’-এর মাধ্যমে ভারত থেকে দূর্নীতি দূর করার আন্দোলনে নেমেছিলেন প্রবীন সমাজসেবী আন্না হাজারে। তখনও দেশের কোথাও আম আদমি পার্টির (আপ) চিহ্নমাত্র ছিল না।
২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর ঝাড়ু প্রতীক নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে আম আদমি পার্টি (আপ)। দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ইন্ডি্য়ান রেভিনিউ সার্ভিসেসের প্রাক্তন আধিকারিক অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তাঁর হাত ধরে রাজনীতির ময়দানে লড়াইয়ে নেমে পড়ে দল। আর রাতারাতি সাফল্যও হাতের মুঠোয় চলে আসে কেজরিওয়ালের। ২০১৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রথমবার ভারতের রাজধানী দিল্লির শাসনভার চলে আসে ‘আপ’-এর হাতে। মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল।
সেবার ৭০ আসনের মধ্যে ২৮টি আসন পেয়েছিল আপ। কিন্তু সে যাত্রায় শাসনভার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ‘জন লোকপাল বিল’-এ অন্যান্য দল সমর্থন না দেয়ায় মাত্র ৪৯ দিনের মাথায় সরকার ছেড়ে বেরিয়ে আসেন কেজরিওয়াল।
তারপর যা ঘটেছে তা নজিরবিহীন। ২০১৫ সালে আবার নির্বাচন হয়। এবার দিল্লি বিধানসভার ৭০ আসনের মধ্যে ৬৭টি দখল করে নেয় ‘আপ’। তারপর কেজরিওয়াল ও তাঁর দলের নেতারা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন আরও কয়েকটি রাজ্যে পসার জমানোর। সেই লক্ষ্যে পাঞ্জাব ও গোয়ায় পাড়ি দেন তাঁরা। বছরখানেক ধরে প্রস্তুতি নিয়ে দুই রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে অংশ নেয় আপ। সংবাদমাধ্যমও এমন প্রচার হতে শুরু করে, পাঞ্জাব ও গোয়ায় বিজেপি ও তাদের শরিক দল শিরোমণি আকালি দলকে সরিয়ে আপ সরকারের ক্ষমতায় আসা প্রায় নিশ্চিত। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, এই দুই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিল দল। কিন্তু গত ১১ মার্চ ফলাফল আসার পর দেখা গেল, বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদী ঝড়ে উড়ে গেছে ‘আপ’।
এরপর এই হারের কারণ নিয়ে দলের অভ্যন্তরে পর্যালোচনা চললেও তা বেশি দূর এগোয়নি। দলের ব্যর্থতার পরিবর্তে কেজরিওয়াল জোর দিচ্ছেন ইভিএম বা ইলেক্ট্রনিক্স ভোটিং মেশিনে কারচুপির অভিযোগের ওপর। এক্ষেত্রে তাঁর অভিযোগের তীর নির্বাচন কমিশন এবং কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপির দিকে।
এরই মধ্যে কেজরিওয়াল বনাম নরেন্দ্র মোদীর সরাসরি লড়াই শুরু হয়েছে দিল্লিতে। দিল্লি পৌরসভা নির্বাচন ২৩ এপ্রিল। কেন্দ্রসহ কয়েকটি বড় রাজ্য এখন বিজেপির করায়ত্ত হলেও রাজধানী দিল্লিতে ভিন্ন সুর মোটেই মেনে নিতে পারছেন না মোদী। তাই এবার পাঞ্জাব ও গোয়ার মতোই ‘আপ’-কে দিল্লি থেকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনায় নেমেছে বিজেপি। বর্তমানে দিল্লির পৌরসভাগুলো বিজেপির দখলে। বিজেপির হাত থেকে সেগুলো দখল করতে মরিয়া কেজরিওয়াল এখন ‘কল্পতরু’ হয়েছেন। দিল্লিবাসীর জন্য একের পর এক উপহার ঘোষণা করছেন তিনি। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পরিবহণের ক্ষেত্রে থাকছে জনমোহিনী নানা উদ্যোগ।
মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল রাজধানীর বাসিন্দাদের খুশি করতে যে সব উপহার দিচ্ছেন, তার মধ্যে রয়েছে সরকারি বাসে ছাত্রছাত্রী ও প্রবীণ নাগরিকদের বিনামূল্যে ভ্রমণ, অস্থায়ী স্কুলশিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি, সরকারি হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিত্সা না করানো গেলে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিত্সার ব্যবস্থার মতো বিভিন্ন উদ্যোগ৷। যাঁদের আয় মাসে ২০ হাজার টাকা বা তার কম, তাঁরাও সরকারি বাসে বিনা মূল্যে যাতায়াত করতে পারবেন। নারীরা সারা মাস বাসে চড়তে পারবেন মাত্র আড়াই শ’ টাকায়। এ ছাড়া সরকারি স্কুলে অস্থায়ী শিক্ষকদের বেতন বাডি়য়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে। এতদিন তাঁরা মাসে ১৬ হাজার টাকা পেতেন, এখন পাবেন ৩২ হাজার টাকা।
স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতি ঘটানোর জন্যও সচেষ্ট হয়েছে দিল্লি সরকার। কোনো রোগীকে যদি সরকারি হাসপাতালে মাস দুয়েকের মধ্যে চিকিত্সা করানো না যায়, তা হলে নির্দিষ্ট কিছু বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর চিকিত্সার ব্যবস্থা করা হবে এবং সেই চিকিত্সার খরচ বহন করবে সরকার। দিল্লির সরকারি হাসপাতালগুলিতে যাবতীয় পরীক্ষা বিনামূল্যে হবে। তার মধ্যে থাকছে সি টি স্ক্যানের মতো কিছু পরীক্ষাও, যার খরচ যথেষ্ট বেশি।
কেজরিওয়াল যে হঠাত্ এমন দানছত্র খুলে বসেছেন তার কারণ, দিল্লির পৌরনির্বাচন। সেই নির্বাচনে দিল্লির পৌরসভাগুলো বিজেপির কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়াই লক্ষ্য ‘আপ’ প্রধানের। কিছু হাসপাতাল এবং সরকারি স্কুল, বাস ও পানি সরবরাহের মতো অল্প কয়েকটি ক্ষেত্রই দিল্লি সরকারের এক্তিয়ারে রয়েছে। তাই সেসব ক্ষেত্রেই যতটা সম্ভব কম খরচে, বা একেবারে বিনামূল্যে পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা করছেন কেজরিওয়াল।
এর পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রীর একটা ১৪ মিনিটের ভাষণের ভিডিও ক্যাসেটও প্রকাশ করেছে ‘আপ’। কেজরিওয়াল সেখানে বলছেন, ‘‘দিল্লিকে পরিচ্ছন্ন ও স্বচ্ছ করতে গেলে ‘আপ’-কেই ভোট দিতে হবে।’’
দিল্লিতে পৌরসভা একেবারে দুর্নীতিমুক্ত, এমন দাবি করা মুশকিল। এই অবস্থায় কেজরিওয়াল বলছেন, ‘আপ’ যদি পৌরসভায় আসতে পারে, তা হলে পরিচ্ছন্ন দিল্লি ও দুর্নীতিমুক্ত পৌরসভা উপহার দেবে।
‘আপ’ প্রধানের অভিযোগ, যাঁরা কিছুদিন আগে পর্যন্ত সাইকেল বা স্কুটারে যাতায়াত করতেন, তাঁরাই আজ পৌরসভায় জিতে এসে বাড়ি-গাড়ি হাঁকাচ্ছেন। পৌরসভায় দুর্নীতির একটা উদাহরণও দিয়েছেন তিনি। রানি ঝাঁসি উড়ালপুল, যা বানাতে খরচ ধরা হয়েছিল ১৭৭ কোটি টাকা, এখন পর্যন্ত ৭২৪ কোটি খরচ হয়ে গিয়েছে, তবু কাজ শেষ হয়নি। অন্য দিকে দিল্লি সরকার গত দু’বছরে পাঁচটি উড়ালপুল নির্দিষ্ট খরচে এবং নির্ধারিত সময়ের আগে শেষ করে দিয়েছে।
এভাবেই যে অস্ত্রে নরেন্দ্র মোদী বিরোধীদের ঘায়েল করেন, সেই অস্ত্র প্রয়োগ করেই কেজরিওয়াল দিল্লিতে বিজেপি-বধ করতে চাইছেন। সূত্র : ডয়চে ভেলে