কৈলাসের কর্মসূচিতে বাংলাদেশে ৬০ লাখ উদ্যোগী
---
অধিকার বঞ্চিত শিশুদের জীবন মান উন্নয়নে নোবেলজয়ী কৈলাস সত্যার্থীর নেওয়া বিশ্বব্যাপী উদ্যোগের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের যুব সম্প্রদায়ের ৬০ লাখ সদস্যকে উদ্যোগী করার কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেছে।
রোববার গণসাক্ষরতা অভিযানের সমন্বয়ে সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তরুণ শিক্ষার্থীদের এক সমাবেশে এই কর্মসূচির উদ্বোধন করেন কৈলাস সত্যার্থী।
‘১০ কোটি শিক্ষা বঞ্চিত মানুষের জন্য আমরা দশ কোটি’ শীর্ষক ওই মূল কর্মসূচিতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের অধিকার বঞ্চিত ১০ কোটি শিশুর জীবন মান উন্নয়নে যুব সম্প্রদায়ের ১০ কোটি সদস্যকে উদ্যোগী করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশের ৬০ লাখ যুবাকে উদ্যোগী করার কাজ করবে গণসাক্ষরতা অভিযান, যারা এই দেশের ৬০ লাখ সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য কাজ করবে।
এ বিষয়ে গণস্বাক্ষরতা অভিযানের ধারণাপত্রে বলা হয়, ‘এদেশের সুবিধাবঞ্চিত ৬ মিলিয়নের বেশি শিশুকে সুস্থ জীবনে ও শিক্ষায় ফিরিয়ে আনা, আদিবাসী ও প্রতিবন্ধী শিশু-যুবদের শিক্ষা ও উন্নয়নে যুক্ত করা এবং শিশু-কিশোর-যুব নারীদের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশেও এই ক্যাম্পেইন পরিচালনার উদ্যোগ গৃহিত হয়েছে।’
বিভিন্ন যুব সংগঠন, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে পরিচালিত হবে এই ক্যাম্পেইন।
এ বিষয়ে গণসাক্ষরতা অভিযানের উপ-পরিচালক কে এম এনামুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাংলাদেশে এই কর্মসূচির আওতায় ৬০ লাখ মানুষকে টার্গেট করা হয়েছে।
“৬ মিলিয়ন সুবিধা বঞ্চিত শিশুর জন্য ৬ মিলিয়ন মানুষের কাছে এই কর্মসূচি নিয়ে যাওয়া হবে। আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাজের প্রাথমিক সময় নির্ধারণ করেছি। এরপর পর্যালোচনা করব। অগ্রগতি বিবেচনায় নিয়ে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।”
২০১৪ সালে ভারতের শিশু অধিকার কর্মী কৈলাস সত্যার্থী তালেবান হামলায় বেঁচে যাওয়া পাকিস্তানি কিশোরী মালালা ইউসুফজাইয়ের সঙ্গে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান।
এরপর ২০১৬ সালে তার উদ্যোগে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একযোগে চালু হয় ‘১০ কোটি শিক্ষা বঞ্চিত মানুষের জন্য আমরা দশ কোটি’ শীর্ষক কর্মসূচি। গত ১১ ডিসেম্বর প্রথম দেশ হিসাবে ভারতে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী এই কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এর প্রায় চার মাস পর বাংলাদেশে কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে।
অনুষ্ঠানে কৈলাস সত্যার্থী বলেন, “আজকের এই দিন খুবই বিশেষ দিন। আজ পুরো পৃথিবী বাংলাদেশের তরুণদের ওপর নজর রাখছে, বাংলাদেশ জাতির ওপর নজর রাখছে, যারা আজকে এবং এখনই ইতিহাস তৈরি করতে চায়।”
তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করেন, “তোমরা কি ইতিহাস তৈরি করতে চাও?”
সবাই সমস্বরে ইতিবাচক জবাব দিলে তিনি বলেন, তরুণদের শক্তির সাথে পাল্লা দিতে পারে জগতে এমন কোনো শক্তি নেই।
একাত্তরে নিজের স্মৃতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “একাত্তরের সেই সময়ে আমি যখন তরুণ ছিলাম, তখন আমি একটি গান শিখেছি, যা এখন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত।”
তিনি বাংলাদেশকে তার ‘সেকেন্ড হোম’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
বক্তব্যের মূল অংশ ইংরেজিতে, কিছু কিছু হিন্দিতে দিলেও এরপর তিনি বাংলায় বলেন, “আমাদের ভবিষ্যত আমরাই গড়ব।”
এগিয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে বক্তব্যের মধ্যে বাংলাদেশের প্রথম নারী এভারেস্টবিজয়ী নিশাত মজুমদারকে মঞ্চে ডেকে নিয়ে তিনি বলেন, “কৈলাস হিসেবে আমি সর্বোচ্চ। কিন্তু তুমি আমার চেয়েও ওপরে।”
এই উদ্যোগের বাংলাদেশ পর্বের উদ্বোধন করতে দুপুরের পর সেন্ট যোসেফ সমাবেশস্থলে এসে পৌঁছেন কৈলাস সত্যার্থী। ঢাক-ঢোল বাজিয়ে শিক্ষার্থীরা বরণ করে নেন তাকে। পরে অনুষ্ঠানস্থলে থাকা অতিথিদের পরিচয় করিয়ে দেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী।
এরপর বক্তব্য পর্বের শুরুতেই ডাকা হয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান, পানি সম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, শ্রম প্রতিমন্ত্রী মজিবুল হক চুন্নু, পিকেএসএফের চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, সাবেক শিক্ষা উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমানকে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “আমাদের দেশ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। একাত্তরের সেই বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে অনেকভাবে। আমাদের শিশুদেরকে আমরা স্কুলে আনতে পেরেছি। এখন আমরা মান নিশ্চিত করতে চাই।”
পানি সম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, “আপনি একটা আন্দোলন শুরু করেছেন, আপনি এ জন্য কারও দিকে না তাকিয়ে তাকাচ্ছেন আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের দিকে। তাদের নিয়েই আপনি শিশু শ্রম বন্ধ করতে চান। নারী নির্যাতন বন্ধ করতে চান।”
‘অসাধারণ’ এই উদ্যোগে শামিল থাকার কথা জানান মন্ত্রী।
শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, “ওনার বড় একটা কাজ ছিল শিশুশ্রম। আমরাও শিশুশ্রম নিরসনের কাজ করে যাচ্ছি। গৃহ শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে আমরা আইন করছি। এটি বাস্তবায়িত হলে তাদের ছুটি থাকবে, অন্যান্য অধিকার থাকবে।”
বার্ধক্যে পৌঁছে গেছেন উল্লেখ করে পিকেএসএফের চেয়ারম্যান খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, “এখন যা কিছু শক্তি বাকী আছে, যা কিছু অভিজ্ঞতা আছে, সেগুলো তোমাদের জন্য ব্যবহার করে যাব।”
সাবেক শিক্ষা উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, “আমরা যারা সুবিধাভোগী তারা সুবিধাবঞ্চিতদের পাশে দাঁড়াব। সবার সাথে আমরাও এটার সাথে যুক্ত হচ্ছি। আমরা আজ শপথ নেব। সেই শপথ এখানকার সকলের হৃদয়ে যদি যায়, সেটাই হবে এই অনুষ্ঠানের স্বার্থকতা।”
দ্বিতীয় দফায় বক্তব্য দেন কৈলাস সত্যার্থী, বাংলাদেশের একমাত্র কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি রোজারিও, মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী।
কৈলাসের এই উদ্যোগকে বাংলাদেশের সবার জন্য খুবই উদ্দীপনাময় উল্লেখ করে কার্ডিনাল প্যাট্রিক বলেন, “আমাদের এক হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই সব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমরা বঞ্চিত শিশুদের জন্য নেওয়া ১০ কোটি মানুষের উদ্যোগে শামিল হব।”
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী বলেন, “আজকের এই অনুষ্ঠানে আমি এতটাই বিমোহিত যে, শিক্ষার্থীদের সাথে আমারও শিক্ষা জীবনে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে।”
শপথ গ্রহণের আগে অনুষ্ঠানে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, “সামনে যারা বসে আছেন, আমার এত শ্রদ্ধাভাজন মানুষ, কাকে বাদ দিয়ে কাকে বলব, বুঝতে পারছি না।
“আজ আমরা তাদের সামনে শপথ নেব। তাদের সামনে আমি শপথ নিলাম, বাড়ি চলে গেলাম, ভুলে গেলাম, সেটা হবে না। মুরুব্বিদের সামনে শপথ নেব।”
কৈলাসের বক্তব্যের আগে হাত ওপরে তুলে সবাই শপথ বাক্য পাঠ করেন। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক অভিনয় শিল্পী মনির খান শিমুল এই পর্ব পরিচালনা করেন।
অনুষ্ঠানের শেষ দিকে ‘আমরা করব জয়’ গান পরিবেশন করা হয়। এই গানে ইংরেজি ও হিন্দি ভার্সনে কণ্ঠ মেলান কৈলাস। হিন্দি অংশের সূচনা করেন কৈলাসের সহধর্মিনী সুমেধা কৈলাস। বাংলা ভার্সনে সুর ধরেন মনির খান শিমুল। অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত অন্যরাও এ সময় কণ্ঠ মেলান।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী, প্রাক্তন শিক্ষা সচিব এনআই খান, এভারেস্টজয়ী এমএ মুহিত, কথা সাহিত্যিক আনিসুল হক প্রমুখ।
গানের দল ‘জলের গান’ অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে সঙ্গীত পরিবেশন করে।
ভারতে যারা শিশু অধিকার আন্দোলনের নেতৃত্বে, ১৯৫৪ সালের ১১ জানুয়ারি মধ্যপ্রদেশে জন্ম নেওয়া কৈলাস তাদেরই একজন।
১৯৯০ এর দশক থেকে শিশু অধিকার প্র্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ব্যাপকভাবে সক্রিয় হলেও কৈলাস সত্যার্থীকে বিষয়টি প্রথম নাড়া দেয় মাত্র ৬ বছর বয়সে।
শৈশব কৈশোরে বেশ কিছু উদ্যোগের পর ১৯৮০ এর দশকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি ছেড়ে পুরোদমে শিশু অধিকারের আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন কৈলাস।
গড়ে তোলেন ‘বাচপান বাঁচাও’ আন্দোলন, যে সংগঠনটি সারা ভারতে এ পর্যন্ত ৮০ হাজারেরও বেশি শিশুকে শ্রমের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে পুনর্বাসন আর শিক্ষাও নিশ্চিত করেছে।
শুধু ভারত নয়, কৈলাস বিশ্বব্যাপী নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডেও নিজেকে জড়িয়েছেন। গ্লোবাল মার্চ অ্যাগেইনস্ট চাইল্ড লেবার, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার অন চাইল্ড লেবার অ্যান্ড এডুকেশনের পাশাপাশি গ্লোবাল ক্যাম্পেইন ফর এডুকেশনের সঙ্গেও কাজ করে যাচ্ছেন।
কম্বল ও কার্পেট প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশুদের শ্রমিক হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে কি-না তা পর্যবেক্ষণ করে সনদ দেওয়ার জন্য কৈলাস গড়ে তোলেন ‘রাগমার্ক’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, যা বর্তমানে ‘গুডউয়েভ’ নামে পরিচিত।
তার এই সংগঠন ১৯৮০ এবং ৯০-এর দশকে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে কারখানায় শিশুশ্রম ব্যবহারের বিষয়ে ক্রেতাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে প্রচার চালায়। এর ফলে বিশ্বজুড়ে কার্পেট প্রস্তুত ও সরবরাহে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে।
শিশুশ্রমকে একটি মানবাধিকার ‘ইস্যু’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি একে কল্যাণ ও সেবামূলক বিষয় হিসেবে তুলে ধরতেও সক্ষম হন কৈলাস।
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অধিকার বঞ্চিত ১০০ মিলিয়ন শিশুর অধিকার আদায়ে নতুন করে উদ্যোগ নেন কৈলাস।