শনিবার, ১১ই মার্চ, ২০১৭ ইং ২৭শে ফাল্গুন, ১৪২৩ বঙ্গাব্দ

৭ মার্চই স্বাধীনতার ঘোষণার চাপ কেন ছিল, প্রশ্ন হাসিনার

AmaderBrahmanbaria.COM
মার্চ ১০, ২০১৭

একাত্তরের সাতই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের দিনেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে দলের ভেতর থেকে ‘কারা, কী উদ্দেশ্যে’ চাপ দিচ্ছিল, তা খুঁজে দেখার কথা বলেছেন তার মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সেদিন সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে আন্তর্জাতিকভাবে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারত- এমন ইংগিত করে তিনি বলেছেন, “তাহলে, তারা (যারা চাপ দিচ্ছিল) কার হয়ে কথা বলছিল? উদ্দেশ্যটা কী ছিল?”

সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের ওপর শুক্রবার ঢাকায় এক সেমিনারে প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য আসে।

তিনি বলেন, “আক্রমণকারী কারা হবে? যারা আক্রমণকারী হবে, আন্তর্জাতিকভাবে তারাই হবে অপরাধী। আর কোনোমতেই বিচ্ছিন্নতাবাদী হওয়া যাবে না। তাহলে কখনো কোনো উদ্দেশ্য সফল হয় না।”

তেইশ বছরের শোষণ-বঞ্চনার অবসানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিস্মরণীয় সেই ভাষণের পর মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেছিল বাঙালি জাতি। এ কারণে ৭ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময় একটি দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে লাখো জনতার সেই সমাবেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।”

সেই ভাষণের পর ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী শুরু করে নৃশংস গণহত্যা। আর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট আয়োজিত সেমিনারে সাড়ে চার দশক আগের সেই স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে শেখ হাসিনা তার ভাষায় কিছু ‘রুঢ়’ কথা বলেন।

বঙ্গবন্ধুর বড় সন্তান শেখ হাসিনা সেদিন তার বাবার গাড়িবহরের সঙ্গেই তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে গিয়েছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানা।

জনসভা শেষে তাদের গাড়ি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হয়ে ফুলার রোড দিয়ে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে ফেরে। পথে রেসকোর্স ময়দান থেকে বাঁশের লাঠি হাতে স্লোগান মুখর স্বতঃস্ফূর্ত জনতাকে ফিরতে দেখার কথা সেমিনারে তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।

বাড়ি ফিরে শেখ হাসিনা যা দেখেছিলেন; সেই ঘটনা তিনি তুলে ধরেন তার বক্তব্যে।

“আমি যখন ঘরের মধ্যে ঢুকলাম, ঠিক সেই সময় দেখি, আমাদের কয়েকজন ছাত্রনেতাসহ বেশ কিছু … তারা হটাৎ দেখি বেশ উত্তেজিত। আমার আব্বাকে বলছেন, ‘এটা কী হল লিডার? আপনি স্বাধীনতার ঘোষণাটা দিয়ে আসলেন না। মানুষ সব হতাশ হয়ে ফিরে গেল’।

“ঠিক এই কথাটা যখন বলছে, তখনই আমি ভেতরে ঢুকেছি। ঢুকে সাথে সাথে আমি বললাম, আপনারা মিথ্যা কথা বলছেন কেন? আমি একটু টাশ টাশ মুখের ওপর কথা বলে দেই; এটা আমার অভ্যাস।

“আমি বললাম, আপনারা এই রকম মিথ্যা কথা বলেন কেন? মানুষ কোথায় হতাশ হয়ে গেছে? তাহলে আপনারা মানুষ দেখেন নাই। আমি কিন্তু মানুষ দেখতে দেখতে আসলাম। মানুষের ভেতরে যে উৎসাহ উদ্দীপনা আমি দেখলাম, তাতে আমি তো কারও মুখে কোনো হতাশা দেখলাম না। আপনারা কেন আব্বাকে এরকম মিথ্যা কথা বলেন। আব্বাকে এরকম মিথ্যা কথা বলবেন না।”

শেখ হাসিনা বলেন, সেদিন যাদের তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে চাপাচাপি করতে দেখেছিলেন, তাদের কথায় কান না দিতে বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে।

“আমি আব্বাকে সোজা বললাম, আব্বা আপনি ওদের কথা বিশ্বাস করবেন না। কারণ সবাই মিথ্যা কথা বলছে। মানুষ কিন্তু সাংঘাতিক উজ্জীবিত হয়ে যাচ্ছে। সবাই স্লোগান দিতে দিতে হলে যাচ্ছে।”

সেদিন ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা’, ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’ স্লোগান দিতে দিতে জনতার পথচলা দেখার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “সেই সময়কার সমস্ত স্লোগান দিতে দিতে মানুষ এগিয়ে যাচ্ছিল।”

শেখ হাসিনা বলেন, সেদিন যাদের তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে কথা বলতে দেখেছিলেন, তাদের কেউ কেউ পরে আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে গেছেন। কেউ কেউ গিয়ে আবার ফিরেও এসেছেন।

“এরকমও কেউ ছিল… অনেকে চলে গিয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র থেকে অনেক কিছু করতে চেষ্টা করেছে।”

স্বাধীনতার পর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগ ছেড়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠনে ছিলেন এক সময়ের ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খান এবং ১৯৭১ সালে ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রব ও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ।

ছাত্রলীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ ছেড়ে বাকশাল গঠন করে পরে আবার দলে ফেরেন।

শেখ হাসিনা বলেন, “আমি মাঝে মাঝে চিন্তা করি, তারা ওই কথাটা তখন কেন বলেছিল? এটাও একটু চিন্তা ও বিশ্লেষণের দরকার আছে। কারণ আমি তো অনেক কিছুর সাক্ষী ওই বাড়িতে থেকে।”

কোথায় কোন পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে, কীভাবে যুদ্ধ হবে বা কীভাবে দেশের মুক্তি আসবে- তার সব কিছু বঙ্গবন্ধুই জানতেন বলে সেমিনারে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।তার বক্তৃতায় ২৫ মার্চের কালরাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যাওয়ার কথাও আসে।

“২৫শে মার্চ যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজারবাগ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, তার আগেই আমাদের কাছে একটা খবর আসল। স্বাধীতার বাণীটা আগেই প্রস্তুত করা ছিল।”

সেদিন ৩২ নম্বরে বাসার লাইব্রেরির পাশে বারান্দায় যাওয়ার দরজার পাশে রাখা টেবিলে টেলিফোন থেকে ইপিআরে ফোন করে বঙ্গবন্ধুর বার্তা দেওয়ার কথাও স্মরণ করেন শেখ হাসিনা।

“ওই টেলিফোনে তিনি ম্যাসেজটা ইপিআর ফাঁড়িতে দিয়ে দেন। ওখানে শওকত সাহেবসহ (শহীদ সুবেদার মেজর শওকত আলী) চারজন বসেছিলেন। তারা অপেক্ষায় ছিলেন। যখনই আক্রমণ করবে এই ম্যাসেজটা তারা পৌঁছে দেবে সমস্তা জায়গায়… ওয়্যারলেস, টেলিগ্রাম, টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে সমস্ত বাংলাদেশে তা পৌঁছে যাবে।”

বাঙালির সংগ্রামের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা দেওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু সত্তরের নির্বাচনের মাধ্যমে সেই ঘোষণা দেওয়ার ‘ম্যান্ডেট’ নিয়ে নিয়েছিলেন বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।

“তিনি জনমত নিয়ে নিয়েছিলেন। ওই নির্বাচন করার আগে যারা নির্বাচনে বাধা দিতেন, একটা কথাই তাদের তিনি বলতেন- ‘বাংলাদেশের নেতা কে, এটা জনগণই সিদ্ধান্ত নিয়ে দিক। জনগণই বলে দিক।’ জনগণের যে ম্যান্ডেট, জনগণের যে মতামত, জনগণের যে অনুমোদন; তার একান্ত প্রয়োজন ছিল।”

বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, “জনগণের ম্যান্ডেটটা একমাত্র ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। স্বাধীনতার ঘোষণা কেবল তিনিই দিতে পারেন। সে অধিকার তারই ছিল।

“তার প্রত্যেকটা পদক্ষেপ অত্যন্ত সুচিন্তিত ছিল বলেই আমরা যুদ্ধ করে দেশের বিজয় অর্জন করতে পেরেছিলাম।”

শেখ হাসিনা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত প্রস্তুতি বঙ্গবন্ধু ‘আগেই নিয়ে রেখেছিলেন’।

“তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হলে যুদ্ধ যে চলতে থাকবে, সেটা তিনি জানতেন। ধরেই নিয়েছিলেন, তাকে মেরে ফেলে দেবে। তার অবর্তমানে সব কিছু যেন চলে, তিনি সে ব্যবস্থাও করে রেখে গিয়েছিলেন।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আমাদের অন্তরে অক্ষয়। তিনি বাঙালির হৃদয়ে চিরদিন থাকবেন।”

‘বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ: রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামো পরিবর্তনের দিকদর্শন’ শীর্ষক এই সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিনাত হুদা এবং সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এ আরাফাত প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় অংশ নেন।

এছাড়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাশুরা হোসেন সেমিনারে বক্তব্য দেন।