‘যে হাতে রক্তের দাগ, সে হাত থেকে আমরা ত্রাণ নেব না’
---
গাইবান্ধা প্রতিনিধি : খোলা আকাশের নিচে কাটছে জীবন, কোনও মতে একবেলা জুটছে ভাত গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের উচ্ছেদে অভিযানে গৃহহারা সাঁওতালদের। তবুও সরকারি অনুদান ফিরিয়ে দিয়েছেন তারা। এত অভাবের মধ্যেও কেন সরকারি ত্রাণ নিলেন না, এমন প্রশ্নে তারা বলেন, ‘যে হাতে এখনও রক্তের দাগ, সে হাত থেকে আমরা কোনও ত্রাণ নেব না।’
উচ্ছেদে গৃহহীন সাঁওতালরাক্ষোভ প্রকাশ করে সাঁওতালরা বলেন, ‘এই পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজন আমাদের ভিটে থেকে উচ্ছেদ করেছে। গুলি করে আমাদের দুইজনকে মেরেছে। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি লুট করে নিয়ে গেছে।’ সরকার এবং এমপি ছাড়া অন্য সবার সাহায্য ‘হামরা’ নেব বলেও এসময় জানান তারা।
গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের উচ্ছেদে গৃহহারা রেজিনা সরেন বলেন, ‘নয়দিন ধরে খোলা আকাশের নিচে আছি। হামার ঘর আগুন দিয়া পুড়ায় দিছে। এ্যাকন কই যামু।’ মঙ্গলবার মাদারপুর গ্রামের চার্চের খোলা মাঠে বসে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে আরও বলেন, ‘শুধু বাড়ি-ঘর নয়। ওই আগুনে হাড়ি-পাতিল, থালা-গ্লাস সব পুড়ে গ্যাছে। রান্না করার মতো কোনও বাসন নাই। খাওয়ার মতোও কিছু নেই। গত কয়েক দিনে কিছু ত্রাণ পেয়েছি। এই খোলা আকাশের নিচে ছেলে-মেয়ে নিয়ে কলাপাতায় একবেলা করে খেয়ে কোনরকমে দিন কাটাচ্ছি।’
পাশে বসা জ্যোৎস্না মুরমু বলেন, ‘আগুনে ঘরে থাকা চাল-ডাল, লেপ-তোষক, বালিশ, চকি কিছুই রক্ষা পায়নি। সব হারায়ে তাই খোলা আকাশের নিচে ত্রাণের দেওয়া কম্বল গাঁয়ে দিয়ে এখানেই বসবাস করছি।’ কোনও কাজের সুযোগ না থাকায় সারাদিনে মাত্র একবেলা ভাত খাচ্ছি বলেও যোগ করেন আরেক গৃহহীন মার্টিনা মরমু।
শুধু জ্যোৎস্না, মার্টিনা মুরমু ও রেজিনা সরেন নয়, উচ্ছেদ অভিযানের পর দেড় শতাধিক পরিবার গত দশদিন ধরে এভাবেই মাদারপুর চার্চের খোলা প্রাঙ্গণ ও চার্চের পরিত্যক্ত স্কুলভবনে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, ওই দুই গ্রামের সাঁওতাল পল্লীর ৬শ’ পরিবারের মধ্যে খাদ্য সংকট বিরাজ করছে। অর্থ-যোগানের ব্যবস্থা না থাকায় তারা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও ক্রয় করতে পারছেন না। এদিকে তাদের পক্ষে-বিপক্ষে কিছু গণমাধ্যমে অপপ্রচার করায় সহজে কারও কাছে তারা নিজেদের দাবি-দাওয়া নিয়েও এখন আর সহজে মুখ খুলতে চাইছেন না।
কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে দেওয়া হচ্ছে সাঁওতালদের জায়গাতাদের দাবি কী, এ প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে মাদারপুর গ্রামের ইলিমা টুডু বলেন, ‘একই কথা আর কতবার বলবো, বারবার একই কথা বলতে বলতে আমাদের গলা তো শুকিয়ে গেছে। কিন্তু কোনও কাজ তো হচ্ছে না।’
তবে একই গ্রামের রুনা সরেন বলেন, ‘বাপ-দাদার জমি ফিরাইয়া দেন। হামার বাড়িঘর জ্বালাইয়া দিলো, বাড়ির পালিত গরু-ছাগল পর্যন্ত লুট করে নিয়ে গেলো। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোনও বিচার হইল না।’ একই কথা জানান মাদারপুর গ্রামের ইলিখা মার্ডি।
আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্র সরেন জানান, সাঁওতালদের নামে মামলা প্রত্যাহার করাসহ যাদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদদে উচ্ছেদসহ লুটপাট ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নাই। সাঁওতালদের মূল দাবি এড়িয়ে ত্রাণের নামে সামান্য খাদ্য দিয়ে এবং গালভরা নানা আশ্বাস দিয়ে আমাদের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যা ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসীরা কোনক্রমেই মেনে নেবে না।
প্রসঙ্গত, গত রবিবার (৬ নভেম্বর) গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রংপুর চিনিকলের জমিতে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক কর্মচারীদের হামলায় গুলিবিদ্ধ হন চার জন সাঁওতাল। এতে তিনজন সাঁওতাল মারাও যান। পরে পুলিশ-র্যাব ওই দিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এক অভিযান চালিয়ে মিলের জমি থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করেন। এসময় সাঁওতালদের বাড়িতে আগুন দিয়ে লুটপাট চালানো হয়। কিন্তু সংঘর্ষের ঘটনায় উল্টো গোবিন্দগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক কল্যাণ চক্রবর্তী বাদি হয়ে ৪২ জনের নাম উল্লেখ করে ৩ থেকে ৪শ’ জনকে আসামি দেখিয়ে মামলা দায়ের করে।