শুক্রবার, ১লা জুন, ২০১৮ ইং ১৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

৬ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ১১৮ শতাংশ

Business_10550বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছেই পণ্য ও সেবা দুই খাতেই বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি বেড়েছে ১১৮ শতাংশ। আর সেবা বাণিজ্যে ঘাটতি বেড়েছে ২৬ শতাংশ। সেবা ও বাণিজ্যের এই ঘাটতির প্রভাবে বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। রপ্তানির চেয়ে আমদানি খাতে খরচ অনেক বেশি হওয়ায় বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে বলে মনে করেন অর্থনীতি গবেষক জায়েদ বখত। তবে এই অবস্থায় মোটেও উদ্বিগ্ন নন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান। তিনি বলেছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল এবং খাদ্যপণ্যের দাম কমার পরও আমদানি ব্যয় বাড়া মানে হচ্ছে দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার ‘ব্যালান্স অফ পেমেন্ট’ সংক্রান্ত যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৩১ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

গত অর্থবছরের (২০১৩-১৪) একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল অর্ধেকের কম; ২৪৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার। শতকরা হিসাবে এই ছয় মাসে ঘাটতি বেড়েছে ১১৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ পণ্য রপ্তানি করে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে, পণ্য আমদানির জন্য তার চেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয় বলে বাণিজ্যে ঘাটতি দেখা দেয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশ থেকে দুই হাজার ৪ কোটি ৯০ লাখ (২০ দশমিক ০৪ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ১৮ দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি।

অন্যদিকে, এই ছয় মাসে বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ মোট এক হাজার ৪৭৩ কোটি ৫০ লাখ (১৪ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে, যা ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের চেয়ে ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ বেশি।

ঘাটতির এই হিসাব অবশ্য চূড়ান্ত নয়, রপ্তানি আয় ও আমদানি ব্যয়ের এফওবিভিত্তিক হিসাব। অর্থাৎ আমদানি-রপ্তানির জন্য জাহাজিকৃত পণ্যের প্রকৃত মূল্যভিত্তিক হিসাব। আর তাই রপ্তানির জন্য রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান এবং আমদানির জন্য কাস্টমসের সিঅ্যান্ডএফ (ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং) মূল্যের সঙ্গে কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়।

জুলাই-ডিসেম্বর সেবা খাতে আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হওয়ায় ঘাটতিও বেড়েছে। মূলত বিমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের পরিস্থিতি বিবেচনা করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়।

ছয় মাসে সেবা খাতের বাণিজ্যে ১৫৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার আয়ের বিপরীতে ব্যয় হয়েছে ৪০৭ কোটি ডলার। এ হিসাবে সেবা বাণিজ্যে ২৫০ কোটি ৬০ লাখ ডলারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে তা ছিল ১৯৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, অর্থবছরের ছয় মাসে দেশে নিট প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে ৭০ কোটি ২০ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬ শতাংশ বেশি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে একই সময়ে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৬৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

আলোচ্য সময়ে পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগও বেশ খানিকটা বেড়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে পোর্টফোলিও বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে তা বেড়ে হয়েছে ৪৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার।

লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি ১৪২ কোটি ডলার
বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অর্থবছরের ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) এই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪২ কোটি ২০ লাখ ডলার, গত অর্থবছরের একই সময়ে যেখানে ১৪৪ কোটি ২০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।

এমনকি চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাস (জুলাই-অগাস্ট) পর্যন্তও বাংলাদেশের ব্যালান্স অফ পেমেন্ট (বিওপি) উদ্বৃত্ত ছিল। সেপ্টেম্বর থেকে উল্টোপথে (নেগেটিভ-ঋণাত্মক) হাঁটতে শুরু করে অর্থনীতির এই সূচক।

‘লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি বাড়লেও তাতে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই’ মন্তব্য করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, বর্তমানে ২২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রিজার্ভ মজুদ আছে। এই মজুদ দিয়ে সাত মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

আরও : পাকিস্তানে নিষিদ্ধ কারিনা-সোনমের ‘ভিরে ডি ওয়েডিং’

“দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসায় শিল্প স্থাপনের জন্য ক্যাপিটাল মেশিনারি, শিল্পের কাঁচামাল এবং শিল্প খাতের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্য আমদানি বাড়ায় বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। ব্যালান্স অফ পেমেন্টেও ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

“বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল এবং খাদ্য পণ্যের দাম বেশ কম। তারপরও আমদানি ব্যয় বাড়ছে। এর অর্থ হচ্ছে- দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে।”  তবে দেশে আবারো রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন গভর্নর।

“২০১৩ সালের সংঘাতের রাজনীতি কাটিয়ে ২০১৪ সালে আমাদের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। মূল্যস্ফীতি, রেমিটেন্স, রপ্তানি, আমদানি, রিজার্ভসহ প্রায় সবগুলো সূচকই ছিল ইতিবাচক।

“কিন্তু হরতাল-অবরোধের মধ্য দিয়ে যে নতুন বছর শুরু হয়েছে তা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আবার ২০১৩ সালের মত বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।”

গভর্নরের মতো বর্তমানের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডএস) জায়েদ বখতও।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে ‘বেশ ভালোই’ অগ্রসর হচ্ছিল বাংলাদেশ। বছরের পর বছর ৬ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি ‘ভালোই’ অর্জন। পদ্মা সেতু, মেট্রো রেলসহ বড় বড় কয়েকটি প্রকল্পের কাজও শুরু হয়েছিল।

“কিন্তু এ সব কিছুই এখন সংশয়ের মধ্যে ফেলে দিয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা।”

‘রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় বিনিয়োগ চাহিদা বাড়তে শুরু করায় আমদানিও বাড়ছিল’ মন্তব্য করে জায়েদ বখত বলেন, “তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে উৎসাহিত হয়ে ব্যবসায়ীরা মূলধনি যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি শুরু করেছিল। যার ফলে সার্বিক আমদানি বাড়ছিল।

“কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সে অবস্থা অব্যাহত থাকবে কি না- সেটাই এখন সবার মধ্যে প্রশ্ন?”

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, পর পর দুটি অর্থবছর লেনদেন ভারসাম্যে বড় উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছিল বাংলাদেশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে উদ্বৃত্ত ছিল ২৩৯ কোটি ডলার। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ছিল ১৫৫ কোটি ডলারের উদ্বৃত্ত।

২০১১-১২ অর্থবছরে অবশ্য ৪৪ কোটি ডলারের ঘাটতি (ঋণাত্মক) নিয়ে বছর শেষ করেছিল বাংলাদেশ।

এরপর গত সেপ্টেম্বরের আগ পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য উদ্বৃত্তই ছিল।

চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে অর্থাৎ জুলাই-অক্টোবর সময়ে লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি ছিল ১১৮ কোটি ডলার। পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) তা বেড়ে ১৩২ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ডিসেম্বর শেষে তা আরও বেড়ে ১৪২ কোটি ২০ লাখ ডলারে উঠেছে।

সাধারণভাবে চলতি হিসাবের মাধ্যমে দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি বোঝানো হয়। আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য নিয়মিত আয়-ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। এখানে উদ্বৃত্ত হলে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।

Print Friendly, PDF & Email

এ জাতীয় আরও খবর

বাংলাদেশ এবং থাইল্যান্ডের মধ্যে কৃষি খাতে সহযোগিতা বাড়াতে হবে: প্রধানমন্ত্রী

আমার দিন বন্ধ ঘোষণা : সম্পাদক-ব্যবস্থাপনা সম্পাদক অবরুদ্ধ

ঈদ হয় বাংলাদেশে, শপিং ভারতে

বাংলাদেশের ৮৬.৫ ভাগ মানুষ বর্তমান বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্ট : নসরুল হামিদ

রোহিঙ্গা ইস্যুতে কাজ শুরু করেছে আইসিসি

শপথ নিলেন হাইকোর্টের অতিরিক্ত ১৮ বিচারপতি