‘আমরাওতো মানুষ, আমরা একটু শান্তিতে বাঁচতে চাই’
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ৫নং ওয়ার্ড, এ ওয়ার্ডেই গত ২শ’ বছর আগে ঋষিদের বসবাস শুরু হয়।মূলত ঋষি একটি গোষ্ঠীর নাম। বর্তমানে এই ঋষিগোষ্ঠীর প্রতিটি পরিবারই মানবেতর জীবন যাপন করছে। তাদের মতে, ‘সরকার আসে, সরকার যায়, বিভিন্ন বিষয়ে কোটি কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা হয়ে পাশও হয়, কিন্তু দুঃখ দুর্দশা পিছু ছাড়ে না আমাদের। আমরাওতো মানুষ, আমরা একটু শান্তিতে বাঁচতে চাই’
সরেজমিনে নগরীর ৫ নং ওয়ার্ডের গাংচর-আমির দিঘীর সড়কের গোয়ালপট্টি সংলগ্ন ঋষিপট্টি ঘুরে এবং ওই এলাকায় বসবাসরত ঋষিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ঋষিপট্টির ৯০টি ঘরে ৭শ’ সদস্যর বসবাস। যার মধ্যে ৬/৭ জন সরাসরি চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে জীবন নির্বাহ করেন। বাকিদের মধ্যে কেহ জুতা সেলাই করেন, কেউ বা জুতা তৈরি করেন আবার কেউ পৈত্রিক পেশা চিত্রকরের পেশায় নিয়োজিত আছেন। নিজেরা এই সামান্য আয়ে কোন রকম টিকে থাকলেও নাগরিক সুবিধা নেই বললেই চলে।
ঋষিপট্টির সংঘের সভাপতি হরিদাশ ঋষি জানান, আমরা ৯০টি পরিবারের ৭শ’ জন লোক কতো কষ্টে দিন যাপন করি তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এখানে গত ২০ বছর ধরে সরকারি বেসরকারি কোন উন্নয়ই স্পর্শ করেনি। একমাত্র পানির লাইনটি সকাল ৮ টা থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এই সময়ে সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার পানি সংগ্রহ করি। আমাদের ড্রেনগুলো গত ২০ বছর ধরে কোন সংস্কার হয়নি। আমরাই পরিস্কার করি ড্রেনগুলো। একবারতো এই ঋষিপট্টি তুলে দিতে চেয়েছিলো সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। বহু অনুনয় বিনয় করে উচ্ছেদ ঠেকিয়েছি। জানি না আবার কখন আসে উচ্ছেদের নোটিশ নিয়ে।
ঋষিপট্টি এলাকায় কুমিল্লা জেলা কাঁচা চামড়া উন্নয়ন ও সামাজিক সংগঠনের সভাপতি রতন দাস ঋষি জানান, আমরা চামড়ার ব্যবসা করি বলে আমাদেরকে সবাই আলাদা চোখে দেখে। সরাসরি বলতে গেলে সভ্য সমাজের লোকগুলো আমাদেরকে ঘৃণার চোখে দেখে। আমরা এখানে বহু কষ্টে আছি। এতো ছোট একটি জায়গায় ৭শ’ লোকের বাস। আমাদের আসলে কোন রকম দিন যায় রাত আসে। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার বেশ অপ্রতুল উল্লেখ করে রতন দাশ ঋষি জানান, এখানে সাপ্লাইয়ের পানি বন্ধ হয়ে যায় বলে আমাদের বউ-ঝিরা পুরনো গোমতিতে গিয়ে গোছলসহ দৈনদিন কাজকর্ম সারতে হয়। আপনারা সকালে আসলে দেখবেন খাবার পানির জন্য আমাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। একটি চৌকিতে আমরা ৪ থেকে ৫ জন করে থাকি। তবুও আমাদের তেমন কোন কষ্ট নেই। আমাদের নাগরিক অধিকার হিসেবে এই ড্রেনগুলো পরিস্কার করুক, আমাদের একটু পানির ব্যবস্থা করে দেয়া হউক। আমরাওতো মানুষ, আমরা একটু শান্তিতে বাঁচতে চাই।
ঋষিদের জীবনমান উন্নয়ন নিয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন কি ভাবনা ,তাদের সমস্যা সমাধানে আদৌ কোন পরিকল্পনা আছে কি-না এ বিষয়ে ৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ আবির আহমেদ জানান, ঋষিপট্টির উন্নয়নে আমি সচেষ্ট আছি। এখন পর্যন্ত তাদেরকে একটি পাবলিক টয়লেটের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। একটি পানির লাইনও দিছি। তবে ঋষিপট্টিতে জায়গার সমস্যা বলে তাদের ড্রেনের সংস্কারসহ আরো নানাবিধ কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে এ ঋষিপট্টির উন্নয়নে আমার কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়ন করলে তাদের সমস্যা অনেকটাই শেষ হবে।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো:আবুল ফজল মীর ঋষিদের জীবনমান উন্নয়নের বিষয়ে জানান, ঋষিরা যেহেতু সিটি করপোরেশনের অধীন। তাই তাদের জীবনমান উন্নয়নের বিষয়টা প্রত্যক্ষভাবে সিটি করপোরেশনের সাথে জড়িত। তবে আশার কথা হলো সরকার হিজড়া-ঋষিসহ নিম্ন আয়ের বিভিন্ন পেশা শ্রেণীর মানুষের জীবনমান উন্নয়নে তাদের উন্নত বাসস্থান বিষয়ে কাজ করছে। তাই জেলা প্রশাসন কুমিল্লা অবশ্যই সিটি করপোরেশনের সাথে সমন্বয় করে কুমিল্লার ঋষিদের বিষয়ে পরিকল্পনা করবে।
তবে ঋষিদের জীবন মান উন্নয়নে কর্তৃপক্ষ সচেষ্ট থাকলেও ঋষিদের অসহযোগীতায় তা আর হচ্ছে না বলে জানান, কুমিল্লার সিটি করপোরেশনের মেয়র মো:মনিরুল হক সাক্কু। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের ৫নং ওয়ার্ডে ঋষিদের বসবাস। তাদের জন্য তিনটি মন্দির তৈরি করেছি। তারা এ জায়গাতেই আবার চামড়ার ব্যবসায় করে। যে ঘরে তারা থাকে সে ঘরেই তারা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে। তাহলে কিভাবে তারা সুস্থ্য সুন্দর থাকবে। তাদেরকে বলছি এটা আবাসিক এলাকা। এখানে তোমরা থাকবে ব্যবসাটা নদীর পাড়ে গিয়ে করবে। আমি জায়গার ব্যবস্থা করে দেবো। যেহেতু চামড়া ব্যবসার জন্য প্রচুর পানি প্রয়োজন তাই ব্যবসার সুবিধার্থে নদীরপাড়ে যাও। কিন্তু তারা রাজি না। তবে আমি আবারো তাদেরকে ডাকবো। যদি তারা রাজি হয় তাহলে ঋষিদের জীবনমান উন্নয়নে আমি ব্যাপক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করবো।