মালয়েশিয়ায় রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের মানবেতর জীবন-যাপন
মালয়েশিয়ায় রেমিট্যান্স যোদ্ধারা মানবেতর জীবন-যাপন করছে। একটি কোম্পানিতে অসহায় হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক শ্রমিক। দেশটির সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিনের পর দিন ঠকিয়ে যাচ্ছে সেলাঙ্গুর প্রদেশের শাহ আলম এলাকায় তিলকগংয়ে অবস্থিত ‘হাপ চুং উড প্রোডাক্ট ইন্ডাসট্রিয়াল’ নামে একটি কোম্পানি।
ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় সহায়-সম্বল বিক্রি এবং চড়া সুদে ঋণ নিয়ে তিন থেকে চার লাখ টাকা খরচ করে মালয়েশিয়া এসেছেন বহু শ্রমিকরা। পরিবার পরিজনদের সুখে রাখতেই তাদের এ বিদেশ আসা। সুখ-শান্তি তো দূরের কথা, এই শ্রমিকরা মানবেতর দিন-যাপন করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ১০০০ রিঙ্গিত বেসিক ও ওভারটাইম ভাতা বেসিকের দেড়গুণ এবং সরকারি ছুটির দিনে কাজ করলে বেসিকের দুই গুণ দেয়ার কথা থাকলেও কোনো ওভারটাইম-ই দিচ্ছে না। কন্ট্রাক্ট পেপারে সাইন করলেও বাস্তবে হচ্ছে তার উল্টো।
প্রতি মাসের ৭ তারিখে বেতন দেয়ার কথা থাকলেও মাসের ২০-২২ তারিখের আগে বেতন দেয়া হয় না। কিন্তু দেশের এনজিও এবং ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এসব মানছে না। তারা মাসের ১০ তারিখ পার হলেই প্রবাসীর বাড়ি এসে কিস্তির জন্য চাপ দিচ্ছে।
এছাড়াও কোনো শ্রমিক অসুস্থ হলে তাকে মেডিকেলে নিতে গড়িমসি করে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। ৪-৫ দিন পর মেডিকেলে নেয়া হয় তাও আবার বিকেল ৫টার পর। অথচ ৫টার পর হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার থাকেন না।
এছাড়া অসুস্থতা নিয়ে কেউ কাজ না করলে তাকে গুণতে হয় জরিমানা এবং যত ঘণ্টা কাজ করবে না পরবর্তীতে ওভারটাইম করে বেসিক পূরণ করতে হয়। বিশেষ করে মালয়েশিয়ান সরকার প্রবাসীদের ভিসার ফি (লেভি) ফ্রি করলেও ওই কোম্পানি শ্রমিকদের বেতন থেকে লেভি কেটে নেয়া হচ্ছে।
অথচ জানুয়ারি ২০১৮ থেকে কোনো কোম্পানি প্রবাসী শ্রমিকদের বেতন থেকে লেভি আদায় করলে কোম্পানির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার আদেশ থাকলেও তারা এ আদেশের তোয়াক্কা করছে না। উল্টো লেভির বিষয়ে কথা না বলার জন্য শ্রমিকদের বিভিন্ন হুমকি-ধামকি দিচ্ছে কোম্পানির কর্তারা।
এদিকে লেভি কাটা নিয়ে অভিনব কায়দায় অবলম্বন করছে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি, এছাড়া জানুয়ারি ২০১৮’র পূর্বে প্রত্যেক মাসের বেতন সিটে লেভি ১৫৫ রিঙ্গিত হোস্টেল ভাড়া ৫০ রিঙ্গিত উল্লেখ থাকলেও জানুয়ারি থেকে বেতন সিটে লেভি ও হোস্টেল ফি উল্লেখ থাকছে না। শুধু ২৫৫ রিঙ্গিত উল্লেখ থাকায় শ্রমিকরা অফিস কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাইলে এ বিষয়ে কথা না বলার জন্য হুমকি দেয়া হয়।
এছাড়াও পুরাতন যেসব বাংলাদেশি শ্রমিকরা কাজ করছেন তাদের বৈধ হয়েও সারা বছর অবৈধ হয়ে থাকতে হয়, কারণ পুরাতন শ্রমিকদের ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার এক-দুই মাস আগে ভিসার ফটোকপি হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়। ভিসার কপি হাতে না থাকায় ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাতে পারছে না শ্রমিকরা।
সে কারণে একদিকে যেমন দেশে টাকা পাঠাতে খরচ বেশি হচ্ছে অন্যদিকে সরকারও রেমিট্যান্স হারাচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ কোম্পানির একজন শ্রমিক প্রতিবেদককে জানান, গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে কলিং ভিসায় ৩৩ জন শ্রমিক বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। অথচ এসব শ্রমিক আসার আগে মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের একটি প্রতিনিধি দল কোম্পানি পরিদর্শনকালে কোম্পানির বিভিন্ন সমস্যার কথা জানতে পারেন, যেসব বাংলাদেশি শ্রমিকরা কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন তারা হাইকমিশনের প্রতিনিধি দলকে অনুরোধ করেন কোম্পানিতে বাংলাদেশি শ্রমিক না দেয়ার জন্য।
কারণ আর কোনো বাংলাদেশি যেন তাদের মতো মানবেতর জীবন-যাপন না করে। প্রতিনিধি দল কোম্পানির পরিবেশ ও অন্যান্য বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে ফিরে যান তারপরেও কিভাবে কার পকেটে বিশেষ সুবিধা দিয়ে এ কোম্পানি বাংলাদেশি শ্রমিক এনেছেন সেটাও গোপন থেকে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে প্রতিকারের জন্য প্রবাসী শ্রমিকরা বাঙালি এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করলে এজেন্সি শ্রমিকদেরকে পাত্তা দিচ্ছে না। অন্যদিকে অনেক শ্রমিক হতাশ হয়ে পরিবার ও নিজের জীবন অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে অবৈধ হয়ে পড়ছেন। অথচ ভাগ্য বদলের স্বপ্ন নিয়ে বিদেশ এসেছেন তারা।
ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত বাংলাদেশি শ্রমিকদের মানবেতর জীবন থেকে বাঁচাতে এবং প্রাপ্য অধিকার পাওয়ার ব্যবস্থা করতে মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে দূতাবাসে যোগাযোগ করা হলে দূতাবসের শ্রম সচিব মো. হেদায়েতুল ইসলাম মণ্ডল বলেন, এ রকম কোনো অভিযোগ দূতাবাসে আসেনি। জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে কর্মীদের বারবার জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। ইমপ্লয়মেন্ট চুক্তি মেনে চলতে। যে কোনো সমস্যা (মালয়েশিয়ায় বা বাংলাদেশে) হলে হাইকমিশনকে জানাতে বলা হয়েছে।
বেতন সংক্রান্ত কোনো সমস্যা হলে হাইকমিশনে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে, +৬০১২৪৩১৩১৫০; ০১২২৯৪১৬১৭, ০১২২৯০৩২৫২