সরকারি গরু খামারে নিলামের অতিরিক্ত গাছ কাটার অভিযোগ
---
নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়িহাটে অবস্থিত আঞ্চলিক দুগ্ধ ও গবাদি উন্নয়ন খামারে নিলাম দেয়ার অতিরিক্ত গাছ ঠিকাদার কেটে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।অপর একজন ঠিকাদার উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) কাছে লিখিতভাবে এমন অভিযোগ করেছেন।
ওই ঠিকাদারের অভিযোগ, শুধু অতিরিক্ত গাছ কাটা হচ্ছে তা নয়, টেন্ডার প্রক্রিয়াতেও সরকারি নিয়ম-নীতি অনুসরণ করা হয়নি। ঠিকাদারের প্ররোচনায় খামারের ব্যবস্থাপক বড় ধরনের দুর্নীতি করেছেন। এতে প্রায় ৫০ লাখ টাকার রাজস্ব হারিয়েছে সরকার।
জানা গেছে, খামারের ভেতরের ৭৩১টি গাছ বিক্রির জন্য প্রায় দেড় বছর আগে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু টেন্ডার প্রক্রিয়ার বিলম্বে এরই মধ্যে অনেক গাছের ওপর থেকে রং উঠে যায়। এ অবস্থায় এখন শুরু হয়েছে গাছ কাটার কাজ। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, তালিকার বাইরের অনেক গাছও কেটে নিচ্ছেন ঠিকাদার।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ১৯ মার্চ প্রথমে গাছগুলো নিলামের দিন ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু ওই দিন খামার ব্যবস্থাপক হঠাৎ করে নিলাম স্থগিত করেন। এর কারণ, ওই দিন ব্যবস্থাপকের পছন্দের ঠিকাদার উপস্থিত ছিলেন না। পরবর্তীতে তৃতীয়বারের মতো নিলামের আয়োজন করে গাছগুলো বিক্রি করা হয়।
জানা গেছে, নিলামে গাছগুলো উপজেলা কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক ইমন মন্ডলের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। ইমন মন্ডল ৩৮৮টি শিশু ও ৩০৯টি বাবলাসহ ৭৩১টি গাছের দাম দিয়েছেন ৯ লাখ টাকা। কিন্তু বর্তমান বাজারে ওই সব গাছের দাম কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা হবে বলে জানিয়েছেন ঠিকাদাররা।
এদিকে ঠিকাদারদের অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, গত ১ মে দ্বিতীয় দফায় নিলাম ডাকা হলে ইমন মন্ডলও গাছগুলোর দাম ২৫ লাখ টাকা দিতে চেয়ে টেন্ডার ড্রপ করেছিলেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে ওই নিলামও স্থগিত করা হয়। পরবর্তীতে তৃতীয় দফার নিলামে একই সংখ্যক গাছ ইমন মন্ডল পান ৯ লাখ টাকায়।
ঠিকাদাররা বলছেন, ১০ লাখ টাকা উৎকোচ নিয়ে খামার ব্যবস্থাপক তোফিকুল ইসলাম ঠিকাদার ইমনকে ২৫ লাখ থেকে কমিয়ে ৯ লাখে গাছ দেয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এতে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ১৬ লাখ টাকা। শুধু তাই নয়, বন বিভাগের নিয়মে দরপত্রের ৩০ শতাংশ জামানত দেয়ার কথা থাকলেও ইমন মন্ডল জামানত দিয়েছিলেন মাত্র ৫০ হাজার টাকা।
ইউএনও অফিসে দাখিল করা অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, মরা ও ঝড়ে পড়া ৩০০টি এবং ৪০০টি গাছের কাটা টুকরা বাদ দিয়ে খামার ব্যবস্থাপকের যোগসাজসে তালিকার বাইরের ৪০০ থেকে ৫০০টি গাছ এরই মধ্যে কেটে নিয়ে গেছেন। এখনও যে গাছে ঠিকাদারের নজর পড়ছে, সেটিতেই পড়ছে কুড়ালের কোপ। অফিসের কর্মচারী ও মাঠকর্মীদের সাথে আলাপ করলে বিষয়টির সত্যতা মিলবে বলেও অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে গোদাগাড়ীর ইউএনও জাহিদ নেওয়াজের মুঠোফোনে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। তাই এ ব্যাপারে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে ঠিকাদার ইমন মন্ডল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, তিনি একটি গাছও বেশি কাটছেন না। নিলামে গাছ না পেয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ছড়াচ্ছেন। আর সম্প্রতি খামার থেকে চোরেরা গাছ চুরি করে নিয়ে যাওয়ায় খামার ফাঁকা দেখাচ্ছে বলেও দাবি তার।
বুধবার সকালে খামারে গিয়ে দেখা যায়, চিহ্নিত করা বহু গাছ এখনও কাটা হয়নি। কিন্তু পড়ে আছে গাছের বহু গুড়ি। গাছ কেটে ফেলায় খা খা করছে গরুর সেডের এলাকাগুলো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুই কর্মচারী বললেন, প্রায় তিন মাস ধরে প্রতিদিন ৭০ জন শ্রমিক গাছ কাটছেন। কিন্তু এখনও গাছ কাটা শেষ হয়নি।
ওই দুই কর্মচারীর দাবি, চিহ্নিত করা গাছ রেখে তালিকার বাইরের গাছগুলোই কাটতে ব্যস্ত ঠিকাদার। এ জন্য শেষ হচ্ছে না গাছ কাটা। তাছাড়া চিহ্নিত করা গাছের মধ্যে অনেকগুলোর রং উঠে গেছে। এতে বাড়তি গাছ কাটা সহজ হয়ে উঠেছে ঠিকাদারের জন্য। অতিরিক্ত কাটা গাছের জন্য খামার ব্যবস্থাপক ঠিকাদারের কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বুঝে নিচ্ছেন বলেও দাবি করেন তারা।
এমন অভিযোগ অস্বীকার করে খামারের ব্যবস্থাপক তোফিকুল ইসলাম বলেন, ঠিকাদার অতিরিক্ত কোনো গাছ কাটছেন না। তবে অনেক দিন আগে চিহ্নিত করায় অনেক গাছের ওপর থেকে রং উঠে গেছে। এ কারণে সব গাছ বুঝিয়ে দিতে তাকেই বেগ পেতে হচ্ছে।
তবে বেলাল হোসেন নামে একজন ঠিকাদার বলছেন, গাছের রং উঠে গেলে সেগুলো নতুন করে চিহ্নিত করা যেত। কিন্তু ব্যবস্থাপক এর কোনো উদ্যোগ নেননি। শুধু তাই নয়, নিলামের বিষয়টি গোপন রাখতে অখ্যাত একটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। ঢাকার কোনো পত্রিকাতেও বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়নি। ইমন মন্ডলকে গাছ পাইয়ে দিতে ঠিকাদার এমন করেছেন বলেও দাবি তার। এ ব্যাপারে তিনি মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
এদিকে গাছ নিলাম কমিটিতে বন বিভাগের একজন প্রতিনিধি রাখার নিয়ম থাকলেও খামার ব্যবস্থাপক তা করেননি বলে জানিয়েছেন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এসএম সাজ্জাদ হোসেন। তিনি বলেন, যে কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাছ কাটতে হলে বন বিভাগের অনুমতি নিতে হয়। অনুমতি দেয়ার মতো কারণ থাকলে বন বিভাগ অনুমতি দেয়। তারপর গাছগুলো তারায় চিহ্নিত করে দেয়।
পরবর্তীতে গাছ নিলাম কমিটিতে বন বিভাগের একজন প্রতিনিধি রাখতে হয়। কিন্তু কমিটিতে বনবিভাগের কোনো প্রতিনিধি রাখা হয়নি। আর গাছের রং উঠে গেলে খামারের পক্ষ থেকে বিষয়টি তাদের জানাতে হতো। তখন বন বিভাগ আবার গাছগুলো চিহ্নিত করে দিত। কিন্তু এ বিষয়টিও বন বিভাগকে জানানো হয়নি।