হাইকোর্ট মাজারে ইফতার: এক কাতারে ধনী-গরিব ও ভক্ত-আশেকান
---
নিউজ ডেস্ক : পবিত্র রমজানে ধনী-গরিব ও ভক্ত-আশেকানদের ঐক্যের মিলনমেলা ঘটে হাইকোর্ট মাজারে ইফতারের সময়। প্রতিদিন শত শত মানুষ এখানে ইফতার করতে জড়ো হয়। চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, দিনমজুর, ভিক্ষুক, পথচারী, পাগল-ফকির, মিসকিন, নারী, বৃদ্ধ, শিশু, মসজিদের ইমাম, খাদেম থেকে শুরু করে নানা পেশার মানুষ এখানে আসে ইফতার করতে। ইফতার ছাড়াও বছর জুড়ে এখানে ফকির-মিসকিনদের জন্য থাকে খাবারের বিশেষ ব্যবস্থা। মাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, হজরত শাহ খাজা শরফুদ্দিন চিশিত (রহ.) ওরফে বাবা ওলি বাংলা মাজার তথা হাইকোর্ট মাজার হিসেবে এই মাজার পরিচিত। এখানে প্রতিদিন গড়ে এক থেকে দেড় হাজার মানুষের ইফতারের আয়োজন করা হয়। মাজারের দুটি অংশে পৃথকভাবে এই ইফতারের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এক অংশ মসজিদে ও অন্য অংশ মসজিদের বাইরের দক্ষিণ দিকের কড়ইতলায় বসে ইফতার করে। মসজিদের ভেতরে পুরুষ ও নারীদের জন্য আলাদা ইফতার করার ব্যবস্থা রয়েছে। মসজিদের উত্তর দিকে আলাদাভাবে নারীদের জন্য ও পুরো মসজিদে পুরুষের জন্য। মসজিদের ভেতরে প্রায় ২৫০-৩০০টি মাঝারি সাইজের প্লাস্টিকের গামলায় ইফতারের সামগ্রী পরিবেশন করা হয়। প্রতিটি পাত্রে চারজন করে বসে।
বড় পাত্রে সাত থেকে আটজন করে বসে। তাদের জন্য পাত্রপ্রতি মুড়ি, ছোলা, খেজুর, পেঁয়াজু, চপ, আম, আপেল, মাল্টা, আনারস ও লেবুর শরবত দেওয়া হয়। মাঝেমধ্যে ভক্তদের পাঠানো খিচুড়ি ও তেহারি থাকে ইফতারের আয়োজনে। নিয়মিত ২০-৩০ জন খাদেম ইফতার প্রস্তুতের কাজ করেন। এছাড়া রোজাদাররাও ইফতার তৈরিতে সহায়তা করে। তিনশ’র বেশি প্লাস্টিকের গ্লাসে রোজাদারদের শরবত সরবরাহ করা হয়। গতকাল ইফতারের আগমুহূর্তে হাইকোর্ট মাজারে গিয়ে দেখা গেছে বিশাল আয়োজন। মসজিদের ভেতরে এক কোনায় ইফতারির সামগ্রী স্তূপ করে রাখা হয়েছে। রান্নার জায়গায় একদল বাবুর্চি ইফতারির সামগ্রী রান্না শেষ করেছেন। রান্নাঘর থেকে ইফতার এনে গামলার ভেতরে সাজানোর কাজ করছেন স্বেচ্ছাসেবক ও খাদেমরা।
এরপর তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে রোজাদারদের সামনে। সময় কমার সঙ্গে সঙ্গে রোজাদারদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পাশাপাশি কয়েকজন ছাত্রনেতাকে মাজারের ভেতরে ইফতারে শামিল হতে দেখা গেছে। পুরুষের পাশাপাশি মাজারের উত্তর দিকে দেখা গেছে নারীদের জন্য ইফতার ব্যবস্থা। ৫০-৮০ জনের মতো নারী ইফতারি সামনে নিয়ে সময়ের অপেক্ষা করছেন। এর বাইরে রাস্তার পাশে অনেক নারীকে ইফতার করতে দেখা গেছে। এদিকে মাজারের দক্ষিণ পাশে কড়ইতলায় খাজা কাসেম আলী চিশতির নামে আলাদা ইফতারের আয়োজন দেখা গেছে। কাসেম আলী চিশতির ভক্তরা জানান, চিশতি সাহেব আগে মাজারের খাদেম ছিলেন। তার মৃত্যুর পর কড়ইতলায় আলাদা ইফতারের আয়োজন করা হয়। এখানে ফকির, মিসকিন, রিকশাচালক ও শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা বেশি। দেখা গেল, প্রায় ২০০টি ছোট প্লেটে নানা পদের ইফতার সাজাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবক ও খাদেমরা। ইফতারের আয়োজন নিয়ে কথা হল মাজারের প্রধান খাদেম ও সিনিয়র সহকারী মোহাম্মদ নূরুল হকের সঙ্গে। তিনি সকালের খবরকে জানান, প্রায় ৩০-৩৫ বছর ধরে মাজারে ইফতারের আয়োজন করা হচ্ছে। সব শ্রেণির মানুষ এখানে ইফতার করতে আসে। ধনী-গরিব ও ভক্তদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। সব মুসলমান ভাই ভাই। সবাই একসঙ্গে একই পাত্রে ইফতার করেন।
তিনি আরও জানান, এ দৃশ্য মুসলমানদের ভেতর থেকে হিংসা-বিদ্বেষ লোপ করে ইমানি চেতনা বাড়িয়ে দেয়। আগে মাজার মসজিদের প্রয়াত মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকী খতিব হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। তাকে হত্যার পর তার ছেলে মাওলানা আহমেদ রেজা ফারুকী পেশ ইমামের দায়িত্ব পালন করছেন। অর্থের জোগান নিয়ে তিনি বলেন, ধনাঢ্য ব্যক্তি ও নতুন-পুরনো ভক্তদের আর্থিক সহায়তা, দান-দাক্ষিণ্য দিয়েই ইফতারের আয়োজন করা হয়। এছাড়া অনেক ভক্ত ইফতারির সামগ্রী পাঠান। কখনও ইফতারের সঙ্কট হলে মাজার কমিটির আলাদা ফান্ড থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। এ ছাড়া ২০ রমজান থেকে শেষ ১০ দিন ৬০ থেকে ৭০ জনের জন্য সেহরি খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এ সময় কিয়ামুলাইল অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রতি রাতে চার পাড়া কোরান শরিফ খতম দেওয়া হয় বলে তিনি জানান। মাজারের পুরনো ভক্ত আবু তাহের জানান, ১০ বছর ধরে তিনি এখানে ইফতার করতে আসেন। এখানে ইফতার করলে মানসিক প্রশান্তি পাওয়া যায়। তিনি নিজেও মাঝেমধ্যে ইফতারির সামগ্রী নিয়ে আসেন বলে জানান। মাজার এলাকায় থেকে ভিক্ষা করেন ষাটোর্ধ্ব সুফিয়া বেগম। তিনি জানান, রোজার মাসে হাইকোর্ট মসজিদে ইফতার করি। অন্য সময় দুপুর বেলা মাজারে খিচুড়ি খাই। যে কেউ এখানে খেতে পারেন বলে তিনি জানান।