‘জঙ্গি বাড়ি’ দেখতে মানুষের ভিড়
নিজস্ব প্রতিবেদক : ফাঁকা মাঠের ভেতর টিনসেড একটি বাড়ি। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বেনীপুর গ্রামের এই ‘জঙ্গি বাড়িটি’ দেখতেই দূর-দূরান্ত থেকে ভিড় জমাচ্ছেন শিশু-বৃদ্ধসহ সব বয়সী উৎসুক মানুষ। শুক্রবার বিকেলের পর থেকে অসংখ্য কৌতুহলী মানুষ ছুটে যাচ্ছেন উপজেলা সদর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরের নিভৃত পল্লীর ওই বাড়িটি এক নজর দেখতে।
গত বৃহস্পতিবার ভোররাত থেকে উপজেলার মাটিকাটা ইউনিয়নের বেনীপুর গ্রামে জঙ্গি সাজ্জাদ আলী ওরফে মিস্টুর এই বাড়িতে অভিযান শুরু করে পুলিশ। অভিযানের শুরুতেই সাজ্জাদ আলীসহ তার পরিবারের চারজন এবং অপর এক জঙ্গি আত্মহুতি দেয়। এর আগে এক নারী জঙ্গির হামলায় নিহত হন ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী। আহত হন চার পুলিশ সদস্যও।
শুক্রবার অপারেশন ‘সান ডেভিল’ নাম দিয়ে দ্বিতীয় দিনের মতো বাড়িটিতে শুরু হয় অভিযান। দুপুর পর্যন্ত চলা অভিযানে বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় বোমা, বোমা তৈরির উপকরণ, অস্ত্র, ও জিহাদী বই। শুক্রবার দুপুরে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের সদস্যরা কাজ শেষ করলে সেখানে কাজ শুরু করে সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের সদস্যরা।
তারা কাজ শেষ করার পর বাড়িটি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পুলিশ বাড়িটিতে তালা দিয়ে রাখে। পরে বিকেলে প্রত্যাহার করা হয় ১৪৪ ধারা। এরপরই বাড়িটি দেখতে ঢল নামে উৎসুক মানুষের। শনিবার বিকেল পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। আশপাশসহ দূর-দূরান্ত থেকে শত শত নারী-পুরুষ ওই বাড়িটি দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন। অনেকেই বাড়িটির ছবি তুলছেন মুঠোফোনে, কেউ বা তুলছেন সেলফি।
শনিবার বিকেলে সরেজমিনে, বাড়িটির দুই পাশে টিনের বেড়া। আর দুই পাশে কঞ্চির ওপর কাঁদা দিয়ে তৈরী বেড়া। অভিযানের শুরুতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বাড়ির পূর্ব পাশের দেয়ালে পানি ছিটিয়ে কিছুটা অংশ ধসিয়ে দিতে পেরেছিলেন। কাঁদা ধসে ওই অংশটি কঞ্চির জানালার মতো হয়ে গেছে। সেখান দিয়েই বাড়ির ভেতর দেখার চেষ্টা করছেন উৎসুক মানুষ।
ওই অংশটি দিয়ে তাকিয়ে দেখা যায়, বাড়ির ভেতরে তিনটি ঘর। ঘরের ভেতর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আসবাবপত্র, দুটি সাইকেল, নিহত বেলী আক্তারের সেলাই মেশিন, সাজ্জাদ আলীর ব্যবসার নতুন কাপড়, ওষুধ, বিভিন্ন ধরনের বই, থালা-বাসন, প্লাস্টিকের টুলসহ বাড়ির সব জিনিসপত্র। বাড়ির বাইরের রান্নাঘরে পড়ে ছিল হাড়ি-পাতিল। একটি ডালিতে ছিল কিছু আলু, করলা, পটল ও ঢেড়স।
পঁচন ধরেছে এই সবজিগুলোতে। সেগুলো দেখে এক নারী দর্শনার্থী বললেন, ‘কী দরকার ছিল এসব কাজে জড়ানোর! একসাথে সব শেষ। এই সবজিগুলোও নষ্ট হচ্ছে। খাওয়ার মতো একজন মানুষও থাকল না।’ পাশেই পড়ে থাকা বাচ্চার দোলনা দেখিয়ে আরেক নারী বললেন, ‘বাচ্চাটার কথাও কী চিন্তায় আসেনি! এই দোলনাটায় এখন কে শোবে!’
বাড়ির আশপাশে তখন কোনো পঁচা লাশ ছিল না। কিন্তু তখনও বাতাসে ভেসে আসছিল পঁচা লাশের গন্ধ। বাড়ি থেকে সামান্য দূরেই কেটে নেওয়া ধানখেতের ভেতর চার জায়গায় দেখা গেল রক্তের দাগ। স্রোতের মতো গড়িয়েছে রক্ত। ভিন ভিন করে উড়ছিল মাছি। রক্তের চারপাশে পড়ে ছিল বিয়ারিংয়ের অসংখ্য বল, যেগুলো শক্তিশালী বোমায় ব্যবহার করা হয়। এক জায়গার রক্তের কাছে পড়ে ছিল একজোড়া চামড়ার স্যান্ডেল। পড়ে থাকা শুকনো রক্তের দাগও ঘিরে দেখছেন মানুষ।
গত বৃহস্পতিবার মাঠের ভেতর নির্জন এই বাড়িটিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান শুরু হলে বাড়ির মালিক সাজ্জাদ আলী, বেলী আক্তার, তাদের ছেলে আল-আমিন, মেয়ে কারিমা খাতুন ও আশরাফুল ইসলাম নামে অপর এক বহিরাগত জঙ্গি আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণে নিহত হয়। এই রক্ত জঙ্গিদের শরীর থেকেই বের হয়েছিল। সে রক্ত থেকেই বের হচ্ছিল পঁচা লাশের গন্ধ।
গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিপজুর আলম মুন্সি জানান, জঙ্গিদের ওই বাড়িটি নিহতদের কোনো স্বজনকে দেয়া হয়নি। সেটি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের জিম্মায় আছে। পুলিশ প্রয়োজন মতো বাড়িটিতে গিয়ে তদন্ত করবে। তদন্ত শেষে বাড়ি নিহতদের স্বজনদের বুঝিয়ে দেয়া হবে।