দক্ষিণাঞ্চলে সাদাসোনা চিংড়ি চাষিরা মড়কে দিশেহারা
এস.এম. সাইফুল ইসলাম কবির : দক্ষিণাঞ্চলের বাগেরহাটে সাদাসোনা খ্যাত বাগদা ও গলদা চিংড়ির ঘেওে অজ্ঞাত রোগে মড়ক দেখা দিয়েছে। এতে চিংড়ি চাষিরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এভাবে চিংড়ি মরতে থাকলে চাষিরা দারুণভাবে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বেন বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
গত তিন সপ্তাহে জেলার কয়েক হাজার ঘেরে হঠাৎ করে চিংড়ি মারা যায়। প্রতিদিনই এর সংখ্যা বাড়ছে। মৌসুমের শুরুতেই জেলার অধিকাংশ উপজেলাতে ঘেরে চিংড়িতে মড়ক লেগেছে বলে চাষি ও জেলা চিংড়ি চাষি সমিতি দাবি করেছে। ঘেরের চিংড়িতে মড়ক দেখা দিলেও চাষিদের তা প্রতিকারে কোনো পরামর্শ দিতে এগিয়ে আসেনি বলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন চাষিরা।
কী রোগে ঘেরের চিংড়িতে মড়ক লেগেছে তা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। তারা আক্রান্ত বাগদা চিংড়ি সংগ্রহ করে রোগ নির্ণয়ের জন্য তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছেন।
বাগেরহাট সদর উপজেলার কাড়াপাড়া ও ষাটগম্বুজ ইউনিয়নের খোন্তাকাটা ও শশীখালীর বিলে ঘুরে দেখা গেছে অধিকাংশ ঘেরে বাগদা চিংড়ি মরে রয়েছে। কোনো কোনো চাষি তার ঘেরের পানিতে নেমে মরা চিংড়ি তুলে উপরে ফেলে দিচ্ছেন। আবার অনেকে ক্ষোভে ঘেরে নামছেন না। মরে যাওয়া চিংড়িতে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। জেলার অধিকাংশ উপজেলায় মাছের ঘেরে একই অবস্থা।
চিংড়ি চাষি সরদার নাসির উদ্দিন বলেন, কয়েক বছর ধরে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার বহরবুনিয়া এলাকায় প্রায় আড়াইশ বিঘা জমিতে চিংড়ি চাষ করছি। চলতি মৌসুমে ফাল্গুন মাসের শেষ দিকে নদী ও হ্যাচারির মিলিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ পোনা ছাড়ি। আমার ঘেরের বাগদা চিংড়ি ৬৬ গ্রেড হয়ে গিয়েছিল। পাঁচ দিন আগে হঠাৎ করে দেখি কোনো চিংড়ি নেই। পরে ঘেরের পানিতে নেমে হাজার হাজার মরা চিংড়ি দেখতে পাই। যা এক মাস পরে তা ধরে বাজারে বিক্রি করতে পারতাম। এতে আমার কয়েক লাখ টাকার আর্থিক হয়েছে।
চিংড়ি চাষি সমিতির সভাপতি ফকির মহিতুল ইসলাম বলেন, বাগেরহাট জেলার সদর উপজেলা, রামপাল, মংলা, মোরেলগঞ্জ উপজেলার অধিকাংশ ঘেরের বাগদা ও গলদা চিংড়িতে মড়ক লেগেছে। তবে বাগদা চিংড়ির ঘেরে মড়কটা সবচেয়ে বেশি। প্রতি বছরই কমবেশি ভাইরাস সংক্রমিত হয়ে চিংড়ি মরে থাকে তবে এবছর মড়ক মহামারি রপ ধারণ করেছে। এতে হাজার হাজার চাষি দারুণভাবে আর্থিক ক্ষতির মূখে পড়েছেন। জেলার অধিকাংশ চাষিরা চড়া সুদ ও ব্যাংকের ঝণ নিয়ে চিংড়ি করে থাকে। মৌসুমের শুরুতে এমন বিপর্যয় চাষিকে সর্বশান্ত করবে। তাই এইসব চাষির তালিকা তৈরি করে সরকারকে সুদমুক্ত ঝণ দেয়ার দাবি জানান তিনি।
বাগেরহাট সদর উপজেলার শশীখালি ও খোন্তাকাটা বিলের চাষি আসাদুজ্জামান রিপন ও শেখ শহীদুল ইসলাম বলেন, গত ১৫ বছর ধরে ৬৫ বিঘা জমিতে চিংড়ি চাষ করছি। প্রতি বছর কোনো না কোনো কারণে ঘেরের চিংড়ি মরে থাকে। তবে এবছর যেভাবে চিংড়িতে মড়ক লেগেছে তাতে আমাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
তারা অভিযোগ করেন জেলার অধিকাংশ মানুষ কমবেশি চিংড়ি চাষ করে থাকেন। বিভিন্ন সময়ে আমরা কোনো না কোনো সমস্যায় পড়ি। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা আমাদের এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের কোনো পথ দেখান না।
বাগেরহাট চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্রের জেষ্ঠ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এইচ এম রাবিকুল ইসলাম বলেন, চিংড়ি চাষিরা যে পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করে তা পরিকল্পিত না। তাদের ঘের প্রস্তুতিতে সমস্যা রয়েছে। যার কারণে মৌসুমের শুরুতেই বাগদা ও গলদা চিংড়িতে মড়ক লেগেছে। ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে চিংড়ি মারা যাচ্ছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। পরীক্ষার জন্য আমরা মরা চিংড়ির নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। পরীক্ষার পর কোনো ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যাবে। এরপর তাদের করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দেয়া হবে।
চাষিদের অভিযোগ অস্বীকার করে বাগেরহাট মৎস্য বিভাগের বিভাগীয় মৎস্য কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. জিয়া হায়দার চৌধুরী বলেন, এ বছর জেলার নয়টি উপজেলায় ৭০ হাজার ঘেরে চিংড়ির চাষ করা হয়েছে। চিংড়ির বার্ষিক উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ২৭১ মেট্রিক টন। চিংড়ি ঘেরে মড়ক লাগার পর আমাদের কর্মকর্তারা মাঠে চাষিদের ঘেরগুলো পরিদর্শন করেছে। আমরা চাষিদের সচেতন করতে নানা পরামর্শ দিচ্ছি। এতে চাষিরা আর্থিক ক্ষতির মূখে পড়েছেন। আমরা চাষিদের তালিকাও তৈরি করছি।
তিনি আরও বলেন, মৌসুমের শুরুতে এই এলাকায় বৃষ্টিপাত অনেক কম হয়েছে। অনাবৃষ্টি ও ঘেরগুলোতে যে পরিমাণ পানি থাকার দরকার তা নেই। ফলে প্রচণ্ড তাপদহে পানি গরম হয়ে অক্সিজেন কমে গেছে। তবে পরীক্ষা ছাড়া কী কারণে চিংড়িতে মড়ক লেগেছে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। পরীক্ষা করতে নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে।