মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ও সূচনাপর্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়া -সিরাজুল করিম
---
আজকের লালসবুজের অহংকৃত পতাকার স্বপ্নের সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখার সূচনা একদিনে নয়, দিনে দিনে বিভিন্ন সুলতানি আমল থেকে রাজাবাদশাহি আমল, নবাবি আমল, বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমল, জমিদারি আর পাকিস্তানি আমলের অধিকার ও নিরাপত্তা হারাবার বেদনার গর্ভেই জন্ম লাভ করে। আর সেইসব বেদনার্ত সময়ে প্রতিবাদ-সংগ্রামে আমাদের এই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অংশীদারিত্ব ছিলো বরাবরই অহংকার করার মতো।
সেই শাসনব্যবস্থার ধারাবাহিকতায় সুলতানি আমল ও রাজাবাদশাহি আমল আর নবাবি আমলের শাসকগণ নিজনিজ এলাকার প্রজাগণকে কিছু কিছু ব্যতিক্রমসহ কিছুটা সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখলেও প্রজা সাধারণের জীবনে শাষনের হাতিয়ার অধিকতর শক্তিশালি হয়ে ওঠে জমিদারী আমরে এসে। বৃটিশ শাসনব্যবস্থার তাবেদার জমিদার গোষ্ঠী খাজনা আদায়ের নামে চালাতে থাকে অত্যাচার নিবর্তন।
তাই সঙ্গত কারণেই সেই প্রাচীন-মধ্য আর আধুনিক যুগের বাঙালি জাতিসত্ত্বার বিনির্মাণের প্রচেষ্টায় প্রতিবাদ-সংগ্রামের একটা পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অনন্য অর্জনের পেছনে। আর এ কারণেই মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বের আগের সেই হাজার বছরের সময়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা আমাদের এই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অসংখ্য অহংকৃত সমূহ অর্জনকেও জানা দরকার।
একতাত্তরের স্বাধীণতার স্বপ্নের পেছনে রয়েছে প্রায় দুইশত বছরের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহ, ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের নীলকর বিরোধী আন্দোলন, লর্ড কাজন ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব করলে এর প্রতিরোধ সংগ্রাম, রাজনৈতিক বিপ্লবী সংগঠন ‘অনুশীলন’ ও ‘যুগান্তর’ এর শাখাভিত্তিক এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৯০৮ সনে প্রতিষ্ঠিত ‘বিপ্লবী কল্যাণ সংঘ’ এর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ১৯২১ ও ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ৮ মে বিপ্লবী নারী কমলা সিংহসহ কতিপয় নারীর আন্দোলন ইত্যাদি।
আমার মতে ‘অতীত-বর্তমান আর ভবিষ্যতের মাঝে সেতুবন্ধন না থাকলে আমাদের তাবৎ কীর্তি মুছে যাবে’, এবং ‘অতীতের অহংকৃত অর্জনকে তুলে ধরে তার সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধির দায়িত্ব নিতে হবে আমাদেরকেই’। তাই এই অত্যাবশ্যক বিবেচনায় ‘মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মনবাড়িয়া’ বিষয়ক আলোচনা গুরুত্ব অপরিসীম।
মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ও সূচনাপর্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়া
আমি মনে করি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা আসলে হাজার বছরের বাঙালি জাতিসত্ত¦ার কথা ভুলে গিয়ে উৎপাদন-অর্থণৈতিক সামাজিক-রাজনৈতিক আর গণমানুষের চলমান জীবনব্যবস্থার বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে যখোন দ্বিজাতিতত্ত্বের অকার্যকর পথে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা থেকেই।
মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক কার্যক্রমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া
আমি আমার বিগত অভিজ্ঞতার আলোকে একজন সচেতন ছাত্ররাজনীতিক ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক গবেষক হিসেবেই আমার বক্তব্যতে তুলে ধরতে চাই্। মনে করি যে, যেকোন সার্বজনীন অংশীদারিত্বমূলক কর্মকান্ডে পিছনের সমূহ সফলতা-ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিতে পারলেই বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি অর্জিত হতে পারে সফলতা আসতে পারে কাঙ্খিত পর্যায়ে। তাই সুলতানি আমল থেকে বৃটিশ আমলের আমাদের কয়েকটি ঐতিহাসিক অহংকৃত সাহসী ঘটনার উল্লেখ করতে চাই, উল্লেখ করতে চাই সেইসব কর্মকান্ডে আমাদের সম্পৃক্ততার কথা।
– মোহাম্মদ বিন তুঘলক ১৩৩৫-১৩৫১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দিল্লীর সিংহাসনে থাকাকালীন বাংলার শাসনকর্তা ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ দিল্লীর সুলতানের অধীনতা অস্বীকার করে স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজধানী সরাইলে স্থাপন করেন।
– ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ২৩ জুন পলাশীর আ¤্রকাননে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি মীরজাফরের চক্রান্তে তাঁর পরাজয় থেকেই মূলত দেশপ্রেম দেশাত্মবোধ চেতনা সমৃদ্ধ মানুষের মনে স্বাধীনতা উদ্ধারের স্বপ্ন জাগে।
– ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহে ব্রিটিশ প্রশাসনিক কাঠামো ত্রিপুরার মুখোমুখি হয়ে আজকের ব্রাহ্মনবাড়িয়ার জনগণ প্রত্যক্ষভাবে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে অহংকৃত সংগ্রামী ইতিহাস সৃষ্টি করেন।
– ব্রিটিশ শাসনশোষনের বিরুদ্ধে ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের নীলকর বিরোধী আন্দোলনের ফলে ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ব্রিটিশরা নীলকর বন্ধ করতে বাধ্য হয় আর সেই আন্দোলনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সেদিনের জনগণের অংশগ্রহণ ছিলো অহংকৃত।
– অবিবক্ত বাংলার তৎকালীন শাসনকর্তা লর্ড কাজন ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব করলে সেবছর ১১ আগষ্ট বিলাতি পণ্য বর্জনের ১৬ অক্টোবর হাটবাজার বন্ধ ঘোষনা করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনগণ সাহসী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন।
– অবিভক্ত বাংলার রাজনৈতিক বিপ্লবী সংগঠন ‘অনুশীলন’ ও ‘যুগান্তর’ এর শাখাভিত্তিক এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৯০৮ সনে প্রতিষ্ঠিত ‘বিপ্লবী কল্যাণ সংঘ’ ব্রিটিশ বিরোধী রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
– ব্রিটিশ বিরোধী প্রত্যক্ষ সংগ্রামের একটি সমৃদ্ধ অহংকৃত স্থান সরাইলের কালিকচ্ছ থেকে সংগ্রামী ক্ষুদিরাম উল্লাসকর দত্তের তৈরি বোমায় ব্রিটিশ হত্যা করতে ধরা পড়ে ১৯০৯ সনে বীরের মতো ফাঁসির মঞ্চে মৃত্যূকে বরণ করেন।
– ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ২১ নভেম্বর ইংল্যান্ডের যুবরাজ ভারত সফরে এলে স্বাধীনতার কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে সাহসী কন্ঠের উচ্চারণে ব্রিটিশ শাসনের অন্যায়-অবিচার-দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সাহসী প্রতিবাদ আন্দোলন করেন।
– ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ললিত মোহন বর্মণের প্রচেষ্টায় ডা. নৃপেন্দ্রনাথ দত্তের সভাপতিত্বে ত্রিপুরা জেলা যুব সম্মেলনে ব্রিটিশ শাসনশোষনের বিরুদ্ধে সাহসী প্রতিবাদ উচ্চারিত হয় এবং সামনে এগিয়ে যাবার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়।
– ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ৮ মে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোগড়া বাজারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিপ্লবী নারী কমলা সিংহসহ কতিপয় নারীর উদ্যোগে বিপ্লবী উর্মিলা দেবীর সভাপতিত্বে দেশে প্রথম ব্রিটিশ বিরোধী মহিলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
– ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ও ৭ জুলাই শহরের কালিবাড়ি মাঠে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ব্যারিস্টার এ. রসুলের নেতৃত্বে জ্ঞানাঞ্জন নিয়োগীর সভাপতিত্বে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে জোরদার করতে সমগ্র ত্রিপুরা জেলা যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
– ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ৮ ডিসেম্বা কসবারগোপীনাথপুর ও ১৪ ডিসেম্বর নবীনগরের কুড়িঘর কংগ্রেস কর্মী সম্মেলন এবং ২৬ ডিসেম্বর নবীনগরের ইব্রাহিমপুর কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিথ হয় যা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে জোরদার করে।
– ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ব্রাহ্শণবাড়িয়ায় মহকুমা ছাত্র সম্মেলন,৮ ফেব্রুয়ারি শাহবাজপুর কংগ্রেস কৃষক সম্মেলন ও ২২ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ত্রিপুরা যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনেরই অংশ।
– ১৬৪২ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন শুরু হলে এই আন্দোলনে জননেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে শান্তি চক্রবর্তী ও দীনেশ চৌধুরীর ৯ মাসের কারাদন্ড হয়।
– ১৯৪৭ ক্রিষ্টাব্দের ১৪ আগষ্ট ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতি তাত্ত্বিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মেও মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে এবং এই পাকিস্তানের শাসকগণের হাতে শাসন ক্ষমতা গেলে শুরু হয় বাঙালি আর বাংলা সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন।
মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বের কার্যক্রমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া
এইসব ঘটনাবলি পিছনের শক্তি হিসেবে কাজ করলেও আসলে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের পরোক্ষভাবে সূচনা হয় ১৯৪৮ এ পাকিস্তানি শাসকের উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৃতিসন্তান ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের প্রতিবাদ, ১৯৫২ এর বাংলা ভাষার দাবিতে সাহসী প্রতিবাদ ও আত্মদান, ১৯৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারির ৫ শহীদ ও ২২ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া পোস্ট অফিস ভবন থেকে সাংবাদিক সামিউল আহমদ খান ফটিক এর নেতৃত্বে পাকিস্তানি পতাকা নামানো, ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৫৮ এর সামরিক শাসনের প্রতিবাদ, ১৯৬২ এর শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের প্রতিরোধ কার্যক্রম, বাষট্টি পরবর্তী স্বাধীন চিন্তার রাজনৈতিক বুদ্ধিবৃত্তিক সেই ‘নিউক্লিয়াস’ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা, ছিষট্টির বাঙালির মুক্তির সনদ ৬-দফা প্রস্তাবের বাস্বায়ন প্রচেষ্টা এবং বাঙালি ছাত্রসমাজের ১১-দফার পথে সাহসে এগিয়ে চলা, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান আর ১৯৭০ এর গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বাঙালির নিরঙ্কুস বিজয়ের পরও দেশের শাসন ক্ষমতা না পাবার প্রতিবাদী কার্যক্রমের মাধ্যমেই। সম্ভাব্য বিভিন্ন তথ্যাদি পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, হাজার বছর আগের সেই সুলতানি আমল থেকে ১৯৭০ এর নির্বাচনে বিজয়লাভ অব্দি প্রায় প্রতিটি কার্যক্রমেই ছিলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কমবেশি সাহসী নেতৃত্ব যা আমার ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আবশ্যিক পাঠ্য ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির পথে’, ‘শিক্ষা-সামাজিক-আত্মিক সমৃদ্ধির পথে’ ইত্যাদি গ্রন্থে কিছুটা তুলে ধরকে চেষ্টা করেছি। আর দেশপ্রেম-দেশাত্ববোধে আমার সমচিন্তার অনুজ কবি ও প্রাবন্ধিক জয়দুল হোসেন তাঁর ‘মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ গ্রন্থে চমৎকার তথ্যায়ণের মাধ্যমে সফলতার সাথে সামগ্রিক ভাবে আমাদের অহংকৃত অংশীদারিত্বের কথা তুলে ধরেছেন যা আমাদের চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তিকে মজবুত করবেই।
চলমান মানবসভ্যতায় যে কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের প্রদত্ত রায়কে উপেক্ষা করলে সেখানেই সার্বজনীন গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটে। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রব্যবস্থায় উৎপাদন-অর্থনৈতিক শিক্ষা-সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রীয়-রাজনৈতিক সর্ববিধ শোষণ-বঞ্চনার গণতান্ত্রিক প্রতিবাদে ১৯৭০ এর নির্বাচনে বাঙালি জাতির বিপুল বিজয়ের পরও যখোন দেশের শাসন ক্ষমতার অধিকারী আমরা হতে পারিনি ঠিক সেদিন থেকেই প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধের শুরু হয়েছিলো।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২ মার্চ ডাকসুর ভিপি আ.স.ম. আবদুর রব এর নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয় যেখানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আবদুর কুদ্দুস মাখন ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা সিরাজুল করিম উপস্থিত ছিলেন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ মার্চ বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানমুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক নির্দেশনা জারি করা হলে সারাদেশ চলতে থাকে সেই নির্দেশনা অনুযায়ী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নেতৃত্বে তখন রাজনীতিক এড. আলী আযম, এড. লুুৎফুল হাই সাচ্চু, এড. জহিরুর হুদা এবং ছাত্ররাজনীতিক আবদুর কুদ্দুস মাখন, মাহবুবুল হক, সহিদ উল্লাহ, হুমায়ুন কবির, সিরাজুল করিমসহ আরো কয়েকজন।
১৯৭১ ক্রিষ্টাব্দের ১২ মার্চ স্থানীয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ব্রাহ্শণবাড়িয়ার ইন্ডাস্ট্রিয়েল স্কুলের শিক্ষক শামসুদ্দিন আহমেদ ৪-৫ কি.মি. প্রচার সক্ষম ট্রান্সমিটার তৈরি করে দিলে তা তিতাস গ্যাস কোম্পানীর ম্যানেজারের কক্ষে স্থাপন করে ১৩ মার্চ স্থাপন ও ১৫ মার্চ থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত তাতে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে প্রচার কার্যক্রম চালানো হয়। অধ্যাপক হারুন অর রশিদ এর নেতৃত্বে স্থানীয় ছাত্র রাজনিিতক, সাহিত্যিক-সাংবাদিক ও শিল্পীবৃন্দ এই বেতার কেন্দ্রটি পরিচালনা করেন যা স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম বেতার কেন্দ্রিক প্রচারনা।
১৯৭১ ক্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি জান্তার কাছে গ্রেফতার হবার পূর্বমুহূর্তে রাত মানে ২৬ মার্চ এর সূচনালগ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষনা করেন। আর এই ঘোষনাটিই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর পক্ষে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে এম.এ. হান্নান কর্তৃক ২৬ মাচ দুপুর ২টা ১০ মিনিটে ও কালুর ঘাট আর্মি ট্রান্সমিটার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমান কর্তৃক ২৭ মার্চ সকালে সম্প্রচার করা হয়। আর এই ঘোষনার মাধ্যমেই শুরু হয় পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালির প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধ যার মাধ্যমে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি পায় তাদের বাংলাদেশ।
ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহ, ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের নীলকর বিরোধী আন্দোলন, লর্ড কাজন ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব করলে এর প্রতিরোধ সংগ্রাম, রাজনৈতিক বিপ্লবী সংগঠন ‘অনুশীলন’ ও ‘যুগান্তর’ এর শাখাভিত্তিক এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৯০৮ সনে প্রতিষ্ঠিত ‘বিপ্লবী কল্যাণ সংঘ’ এর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ১৯২১ ও ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ৮ মে বিপ্লবী নারী কমলা সিংহসহ কতিপয় নারীর আন্দোলন ইত্যাদি আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনপদের অনন্য অহংকৃত অর্জন। ১৯৪৮ এ পাকিস্তানি শাসকের উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৃতিসন্তান ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের প্রতিবাদ, ১৯৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারির ৫ শহীদ ও ২২ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া পোস্ট অফিস ভবন থেকে সাংবাদিক সামিউল আহমদ খান ফটিক এর নেতৃত্বে পাকিস্তানি পতাকা নামানো, ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৫৮ এর সামরিক শাসনের প্রতিবাদ, ১৯৬২ এর শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের প্রতিরোধ কার্যক্রম, ছিষট্টির বাঙালির মুক্তির সনদ ৬-দফা প্রস্তাবের বাস্বায়ন প্রচেষ্টা এবং বাঙালি ছাত্রসমাজের ১১-দফার পথে সাহসে এগিয়ে চলা, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান আর ১৯৭০ এর গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বাঙালির নিরঙ্কুস বিজয়ের সবখানেই ছিলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনগণের সাহসী অংশগ্রহণ। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২ মার্চ বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয় যেখানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আবদুর কুদ্দুস মাখন ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা সিরাজুল করিম উপস্থিত ছিলেন। ১৯৭১ ক্রিষ্টাব্দের ১৩ মার্চ স্থাপন ও ১৫ মার্চ থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বেতাযন্ত্র থেকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে প্রচার স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম বেতার কেন্দ্রিক প্রচারনা জাতির কাছে একটা মাইরন ফলক। আমাদের অনন্য অহংকারের একাত্তরের মহান মুুিক্তযুদ্ধকে জানতে হলে জানওেত হবে এর এতিহাসিক প্রেক্ষাপট, জানতে হবে এর সূচনাপর্বের কার্যক্রম এব এর পাশাপাশি জানতে একাত্তরের নয় মাসের বাঙালির সাহসী প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক ঘটনাবলির ধারাবাহিকতা। আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আমাদের স্বাধীণতার পেছনের এইসব অহংকৃত অর্জনতে তুলে ধরতে পারলেই সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এই নিরাপদ শান্তি-সমৃদিদ্ধ বাংলাদেশকে স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে পারবো।
সিরাজুল করিম : কবি, গীতিকার, প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, উন্নয়ন গবেষক, অপ্রত্দ্বিন্দ্বি কৃষিবিজ্ঞান লেখক, খ্যাতিমান খাদ্য নিরাপত্তা, প্রশিক্ষণ ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ, USAID ও UNDP এর সাবেক জাতীয় পরামর্শক, ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকার প্রধান সম্পাদক, সাপ্তাহিক গণপ্রহরীর উপদেষ্টা সম্পাদক। জাতীয় সাহিত্য পরিষদ এর প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব এবং নারী উন্নয়ন অধিকার ও নিরাপত্তা ফোরাম, বাংলাদেশ এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ।
email : [email protected]