লাশের সঙ্গে ২০ বছর!
নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রায় ৭ বছর আগের কথা। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে দুই ডাকাতের লাশ ভ্যানগাড়িতে তোলা হয়। ততক্ষণে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেছে। কিন্তু নিহতের বাড়িতে লাশ দ্রুত পৌঁছে দিতে হবে। তাই বাধ্য হয়ে অন্ধকার রাতেই রওনা হতে হয়। ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা মহাসড়কের বেলতলী এলাকায় আসতেই হঠাৎ জঙ্গল থেকে ছেঁড়া জামা-কাপড় পড়া এক লোক দৌড়ে এসে ভ্যানগাড়ি আটকে দেয়। লাফ দিয়ে ভ্যানে উঠে লাশের ওপর বসে পড়ে চিৎকার শুরু করে।
প্রথমে ভূত ভেবে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যাই। সারা শরীর ঘামে ভিজে যায়। হাত-পা কাঁপতে থাকে। সামনে একটা দোকান দেখে ভ্যানগাড়ি থামিয়ে বসে পড়ি। লোকটাও গাড়ি থেকে নেমে পাশে এসে বসে। ভয়ে ভয়ে তাকে চা-বিস্কুট খাওয়ার অনুরোধ করি। সেও খেতে রাজি হয়ে যায়। চা-বিস্কুট খাওয়ার পরে তাকে একটা সিগারেট দেই। লোকটা যখন ম্যাচ দিয়ে আগুন ধরানোর পর সিগারেটে লম্বা টান দিচ্ছিল তখন নিশ্চিত হলাম সে আসলে পাগল। তারপরও কেন জানি স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। বুকের মধ্যে ধুকধুক করছিল।
নিজের লাশবহন করা পেশার ২০ বছরের একটি ভয়ানক অভিজ্ঞতার কথা এভাবেই নিউজবাংলাদেশের কাছে বলছিলেন আব্দুল বারেক (৫৫)।
বারেকের বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুর পৌরসভার ছয়গন্ডা মহল্লায়। বাবা মৃত মফিজ উদ্দিন। বিচিত্র এই পেশায় এসে কম পক্ষে সহস্রাধিক লাশ বহন করেছেন। লাশ বহন করতে এখন তার মনে ভয়-ডর নেই। গভীর রাতেও একাকী লাশ নিয়ে ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে যান। ভ্যান চালানোর সময় বারবার পেছনে ফিরে দেখেন লাশটা ঠিক আছে তো।
বারেক জানান, উপজেলায় কারো অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে গৌরীপুর থানা থেকে ডাক পড়ে তার। এরপর ভ্যানগাড়ি নিয়ে লাশ উদ্ধার করার জন্য বেরিয়ে পড়েন তিনি। কখনো দড়িতে ঝোলানো বীভৎস লাশ, কখনো ক্ষত-বিক্ষত, কখনো পচা-গলা লাশ, কখনো আবার দেহের ছিন্নভিন্ন হাত-পা বা মাথার অংশ নির্ভয়ে ভ্যানে তুলে নেন। এরপর লাশ থানায় আনা, ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে নিয়ে যাওয়া, আইনি সকল প্রক্রিয়া, সবশেষ নিহতের লাশ পরিবারের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজটাও বারেক নিজেই করে থাকেন।
এই পেশায় কীভাবে আসলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘২০ বছর আগে গৌরীপুর শহরে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতাম। একদিন পুলিশ উপজেলার শাহগঞ্জ এলাকা থেকে লাশ আনার জন্য লোক খোঁজ করছিল। কিন্তু কেউ রাজি হচ্ছিল না। পরে আমি গিয়ে লাশ আনি। এরপর থেকে কোথাও লাশ আনতে গেলে থানা থেকে আমাকে খবর দেয়া হতো। প্রথম দিকে ভয় করলেও জীবিকার তাগিদেই এই পেশায় জড়িয়ে পড়ি।’’
আব্দুল বারেক বলেন, ‘‘পরিচয়হীন হলে লাশের ময়নাতদন্ত ও বহনের জন্য দারগা বাবুর কাছ থেকে তিন হাজার টাকা পাই। তবে ময়নাতদন্তে খরচ হয়ে যায় এক হাজার টাকা। আর লাশের ওয়ারিশ থাকলে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিতে পারি। গত বছরের নভেম্বর মাসে উপার্জন ভালোই হয়েছিল। ওই মাসে অজ্ঞাতনামা, অপমৃত্যু ও সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৫ জনের লাশ বহন করে প্রায় ১২ হাজার টাকা পেয়েছিলাম।’’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছয়গন্ডা মহল্লায় দেড় শতাংশ জমি আছে বারেকের। সেখানেই ছোট একটি ঘরে তার সংসার। দাম্পত্য জীবনে স্ত্রী ও দুই মেয়ে রয়েছে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। বর্তমানে স্ত্রী আবেদা খাতুন আর চার নাতি-নাতনিদের নিয়েই থাকেন তিনি। তবে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে অভাবের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয় তাকে।
কারণ প্রতিদিনি তো আর লাশ মিলে না। আর লাশ না মিললে উপার্জন বন্ধ। তাছাড়া তার নেই সরকারি বেতন-ভাতা। ঈদ-নবান্ন-বৈশাখেও জোটে না সরকারের উৎসবভাতা। তাই প্রতিদিন লাশের খবরের জন্য থানায় ভ্যানগাড়ি নিয়ে বসে থাকেন বারেক।
এদিকে বয়স বাড়ার সাথে সাথে শারীরিক শক্তিও কমছে তার। তাই ভ্যানের সাথে একটি ব্যাটারিচালিত মটর লাগাতে চাচ্ছেন তিনি। যার মূল্য প্রায় ২০ হাজার টাকা। তবে এই টাকা জোগাড় করার সামর্থ্য নেই তার।
বারেক বলেন, ‘‘অভাব-অনটনের সাথে যুদ্ধ করে আমার সংসার চলে। যখন লাশ থাকে তখন আমার সংসার চলে। আর যখন লাশ থাকে না তখন আমার ঘরে খাবারও জুটে না। তখন চলতে খুব কষ্ট হয়। তাই আমার চাকরিটা মাসিক বেতনের ভিত্তিতে স্থায়ীকরণের জন্য পুলিশ বিভাগ ও সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি। দয়া করে আমাদের দুঃখ-দুর্দশা একটু পত্রিকায় তুলে ধরেন।’’
গৌরীপুর থানার পুলিশ সদস্য আব্দুল কাদির বলেন, ‘‘বারেক শুধু লাশ বহন করে না, লাশ পাহারাও দেয়। গত বছর কোনো এক সন্ধ্যায় ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কে দুর্ঘটনায় ৭ জন নিহত হন। ওই রাতে ওসি স্যার বারেককে থানা কমপ্লেক্সের সামনে সাদা কাপড়ে মোড়ানো লাশের সারি পাহারার দায়িত্ব দেন। কিন্তু রাতের খাবার খেয়ে বারেক ওই লাশের সারিতে সাদা কাপড় গায়ে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। মধ্যরাতে কনস্টেবল আব্দুর রহমান ৮টি লাশ দেখে বিপদ ঘণ্টা বাজিয়ে দেন। শুরু হয় চিৎকার, হই-হল্লা। লাশ বেড়ে গেছে খবর পেয়ে ওসিও ছুটি আসেন। কাপড় সরিয়ে দেখেন, লাশ বাড়েনি, বারেক ঘুমিয়ে আছে। লাশ নিয়ে বারেকের অসংখ্য ঘটনা শুনলে ভৌতিক মনে হয়, যা সত্য।’’
গৌরীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি, তদন্ত) মোর্শেদুল হাসান বলেন, ‘‘প্রতিটি থানায় লাশ বহন করার জন্য একজন করে চালক থাকে। তবে পুলিশ বিভাগে তাদের চাকরি স্থায়ী করার সুযোগ নেই। তারপরও বারেকের বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো।’’