গীবত সততাকে গুনাহে পরিণত করে
---
ইসলাম ধর্ম ডেস্ক : কিছু মানুষ সব সময় নিজেকে বড় করে দেখে, এই আমিত্বের আরেক নাম আত্মপূজা। এটা শুরু হয়ে গেলে আত্মপ্রীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তখন তার আত্মত্যাগের মতো মহৎ বৈশিষ্ট্য দূরীভূত হতে থাকে। ফলে এ স্থানে দানাবাঁধে হিংসা-বিদ্বেষ। আবার হিংসা-বিদ্বেষ থেকেই অপরের প্রতি কুধারণার সৃষ্টি হয়, যা মানুষকে গীবত করতে বাধ্য করে। সুতরাং আত্মপূজা, আত্মপ্রীতি, হিংসা-বিদ্বেষ, কুধারণাই মানুষকে গীবত করতে বাধ্য করে।
এ পরনিন্দা কেবল মুখের বাক্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং চোখের ইশারায়, অঙ্গভঙ্গিতে, শ্রবণে ও লিখনের দ্বারাও গীবত হয়ে থাকে। সর্বপ্রকার গীবতই হারাম। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) বলেন, একদিন আমি হাতের ইশারায় এক স্ত্রীলোককে খর্বাকৃতি বললে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, হে আয়েশা। তুমি গীবত করেছ, থুথু ফেলো। তৎক্ষণাৎ আমি থুথু ফেলে দেখলাম তা কালো বর্ণের জমাট রক্ত। এরূপে কোনো খোঁড়া কিংবা টেরা চক্ষুবিশিষ্ট ব্যক্তির অবস্থা অনুকরণ করার জন্য খুঁড়িয়ে হেঁটে কিংবা চক্ষু টেরা করে চাইলে তার গীবত করা হয়। তবে কারো নাম উল্লেখ না করলে এতে গীবত হয় না। কিন্তু উপস্থিত লোকেরা যদি বুঝতে পারে যে অমুক ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে বলা হয়েছে তবে তা গীবত বলে গণ্য এবং হারাম হবে।
ইবাদতের ত্রুটি-বিচ্যুতির উল্লেখপূর্বক সমালোচনা করাও গীবতের অন্তর্ভুক্ত। যেমন অমুক ব্যক্তি উত্তম রূপে নামাজ পড়ে না অথবা রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে না অথবা নফল নামাজ পড়ে না অথবা রমজানের সব রোজা রাখে না অথবা মাকরুহ্ ওয়াক্তে নামাজ পড়ে।
কোন ব্যক্তিকে তার গুনাহের কারণে অপদস্ত করা এবং তাকে জাহান্নামী মনে করা আল্লাহ তা’য়ালার মর্জিবিরোধী কাজ। বরং যে ব্যক্তি কোন ব্যক্তিকে অপমান করে আল্লাহ তা’য়ালা তার প্রতি অসন্তুষ্ট হন এবং তাকে অপমান করেন, অন্যদিকে যাকে অপমান করা হলো তার গুনাহ্ মাফ করে দেন। বনী ইসরাইলের দুই ব্যক্তির ঘটনা এভাবে উল্লেখিত হয়েছে যে, তাদের একজন সর্বদা ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকতো এবং অপরজন পাপাচারে লিপ্ত থাকতো। ইবাদতে লিপ্ত ব্যক্তি সব সময় পাপাচারীকে হেয় প্রতিপন্ন করতো। একদিন সে চটে গিয়ে বলল, আল্লাহর শপথ! তুমি জাহান্নামে যাবে। কথাটি আল্লাহ্ পাকের অপছন্দ হলো এবং ইবাদতে লিপ্ত ব্যক্তিকে জাহান্নামী এবং পাপীকে জান্নাতী বানিয়ে দিলেন (আবু দাউদ, কিতাবুল বিররি (ওয়াস-মিলাহ)।
মহানবী (সা.) বলেন, “প্রত্যেক মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের জীবন, সম্পদ ও ইজ্জত আব্রুতে হস্তক্ষেপ করা হারাম।”
হযরত আনাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “মিরাজের রাতে আমি এমন একদল লোককে অতিক্রম করলাম যারা নিজেদের নখ দ্বারা নিজেদের মুখমণ্ডল ক্ষতবিক্ষত করছিল। আমি জিবরাইল (আ.)কে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তিনি বলেন, এসব লোক গীবত করতো এবং মানুষের ইজ্জত আব্রু নিয়ে টানাটানি করতো।”
হযরত জাবির (রা.) বলেন, আমরা মহানবী (সা.) এর সাথে সফরে ছিলাম। তিনি দু’টি কবরের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং কবরের বাসিন্দাদ্বয়কে শাস্তি দেয়া হচ্ছিল। মহানবী (সা.) বলেন, তারা দু’জন খুব মারাত্মক কোন গোনাহ করেনি, অথচ তাদের শাস্তি দেয়া হচ্ছে। তাদের একজন মানুষের গীবত করত এবং অপরজন পেশাব করে উত্তমরূপে পবিত্র হতো না। অতঃপর তিনি গাছের দু’টি তাজা ডাল চেয়ে নিয়ে তা দু’ভাগ করে দু’জনের কবরের পাশে গেড়ে দেন এবং বলেন, ডাল দুটি যতক্ষণ তরতাজা থাকবে ততক্ষণ তাদের হাল্কা শাস্তি হবে। (ইবনে আবিদ দুন্য়া)
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, কারো গীবত করো না। আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সামনে এক নারী সম্পর্কে বললাম যে, তার কাপড়ের আচঁল খুব লম্বা। মহানবী (সা.) বলেন, তুমি থুথু ফেলো। আমি থুথু ফেললে মুখ থেকে এক টুকরা গোশত বেরিয়ে আসে।কোন ব্যক্তি অভিনয়ের মাধ্যমে অপর ব্যক্তির দোষ ত্রুটির প্রতি ইঙ্গিত করলে তাও গীবতের অন্তর্ভূক্ত।
মহানবী (সা.) বলেন, “কারো উপস্থিতিতে কোন মুমিন ব্যক্তিকে অপমান করা হলো এবং উপস্থিত ব্যক্তি তাকে সাহায্য করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সাহায্য করল না, কিয়ামতের দিন আল্লাহ্তায়ালা তাকে সৃষ্টিকুলের সামনে অপমানিত করবেন।” (আহমদ, তাবারানী)
যে ব্যক্তি তার (মুসলিম) ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার ইজ্জত রক্ষায় সহায়তা করলো, আল্লাহ্তা’য়ালা কিয়ামতের দিন তার ইজ্জত রক্ষায় সহায়তা করবেন।”(ইবনে আবিদ দুন্য়া)।
“যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার ইজ্জত রক্ষায় সহায়তা করল, তাকে দোযখ থেকে নিষ্কৃতি দেয়া আল্লাহ্তা’য়ালার কর্তব্য হয়ে যায়।”(আহমদ, তাবারানী)
মহান আল্লাহ বলেন, “কেউ খারাপ কাজ করে বসলো অথবা নিজের উপর জুলুম করলো, অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলে সে আল্লাহকে ক্ষমাকারী ও দয়াবান হিসেবেই পাবে।”(সূরা নিসা : ১১০)
সুতরাং এ কথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, গীবত একটি জঘন্য পাপাচার। এ থেকে সবাইকে সতর্কতার সাথে বিরত থাকতে হবে।