নিউজ ডেস্ক : সেলিম উদ্দিন। পেশায় জেলে। নৌকায় করে জাল বেয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। সারা দিন হাঁড়ভাঙা পরিশ্রম শেষে নৌকাতেই ঘুমান। কখনো কোনো রাতে বাড়ি ফেরেন। আবার ভোরের আলো ফুটতেই বেরিয়ে পড়েন জীবিকার তাগিদে।
এভাবেই চলছিল তার গৎবাঁধা জীবন। তিন সন্তানের জনক সেলিমের সংসার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভালোই চলছিল। সব দিন পরিবারের সঙ্গে থাকা হতো না তার। জীবিকার ধরন এমন, অধিকাংশ রাত নৌকায় কাটাতে হয় সেলিমকে।
গত সোমবারও সেলিম নৌকায় ঘুমিয়ে ছিলেন। কিন্তু রাত ১২টা পেরোনোর আগেই সেলিমের হাতে পড়ে পুলিশের কড়া। যেন বা গভীর ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন হানা দেয়, এক বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্ন। স্বপ্নের মতোই দ্রুত ঘটে যায় সবকিছু। কোনো কিছু বোঝার আগেই সেলিম নিজেকে আবিষ্কার করেন থানায়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় সেলিম মনের মধ্যে খুঁজে ফেরেন তার অপরাধ কী; কিন্তু খুঁজে পান না কিছু। পরদিন কোর্ট হয়ে কারাগারে ঠা্ঁই হয় তার।
সেলিমের মতো আরও চারজনকে ওই দিন নৌকা থেকে ঘুমের মধ্যে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
নাসিরনগর সদরের পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা সেলিমের স্ত্রী ফরিদা বেগম এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার স্বামী একজন নিরীহ মানুষ। তাকে নৌকা থেকে পুলিশ কেন ধরল বুঝলাম না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কী আর কইতাম। কিছুই বুঝবার পারি নাই। আমার স্বামীর কী অপরাধ। তাকে কেন পুলিশ ধরিল। এখন আমার পরিবারের খাওয়া-পরা কে দেবে। এই কি দেশের আইন!’
নাসিরনগরে হিন্দু মন্দির ও ঘরবাড়িতে হামলার ঘটনার পর সেখানে চলছে গণগ্রেপ্তার। বেশির ভাগ পুরুষ এখন আর বাড়িতে ঘুমান না। গ্রেপ্তার আতঙ্কে কেউ এলাকা ছেড়েছেন, কেউ বা দিনে বাড়িতে ক্বচিত এলেও রাতে চলে যান নিরাপদ আশ্রয়ে।
ওসমান গনি নামের কলেজপড়ুয়া এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ভাই, বাসায় ঘুমাইতে পারি না। ঘুমাইতে হয় এদিক-সেদিক। যেখানে কোনোদিন যাই নাই, সেখানে গিয়ে এখন রাত কাটাতে হয়। রাত হলেই পুরুষশূন্য হয়ে যায় পুরো নাসিরনগর।’
দত্তমণ্ডল গ্রামের এই তরুণ বলেন, ‘যারা অপরাধী তাদের পুলিশ ধরুক। কিন্তু গণহারে কেন ধরছে। নাসিরনগরের সবাই কি অপরাধী?’
ক্ষোভ প্রকাশ করে ধনপকুণ্ডা গ্রামের ফজলুল হক নামের এক বৃদ্ধ বলেন, ‘মসজিদে নামাজের আজান দিতেও কোনো লোক পাওয়া যায় না এখন। এ কেমন পুলিশি অভিযান। সবাই তো অপরাধ করেনি। তাহলে কেন পুলিশের এত ধরাধরি!’ ‘আসল হোতাদের না ধরে নিরাপরাধ লোকদের ধরলে কি আর এসব বন্ধ হবে’, প্রশ্ন বৃদ্ধের।
জানতে চাইলে নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু জাফর বলেন, ‘আমরা গণগ্রেপ্তার করছি না। যাদের সন্দেহ হচ্ছে তাদেরই ধরা হচ্ছে। নিরপরাধ কেউ ধরা পড়বে না।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা সন্দেহভাজন হিসেবে অনেককেই ধরছি। তবে যাদের সংশ্লিষ্টতা নেই, তাদের ছেড়ে দিচ্ছি।’
নাসিরনগরে হিন্দুপাড়ায় তিন দফা আগুন দেওয়ার ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে শ খানেক মানুষকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রকৃত জড়িতদের ধরিয়ে দিতে গত সোমবার লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে পুলিশ।
ফেসবুকে ‘ধর্মীয় অবমাননার’অভিযোগ তুলে গত ৩০ অক্টোবর নাসিরনগরে ১৫টি হিন্দু মন্দির ও অন্তত দেড় শ বাড়িঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়।
এর পাঁচ দিনের মাথায় ৪ নভেম্বর একই এলাকার কয়েকটি বাড়ি ও মন্দিরে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। ১৩ নভেম্বর নাসিরনগরে ফের হিন্দু বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। তবে এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। পুলিশের দাবি, এলাকাবাসী পাহারা দেয়ার পরও অগ্নিসংযোগের ঘটনা রহস্যজনক।
সরেজমিনে কথা বলে যে তথ্য পায়, তাতে জানা যায়, ৩০ অক্টোবরের হামলার নেপথ্যে কাজ করেছে নাসিরনগরের এমপি ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হকের সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাংসদ র আ ম উবায়দুল মুকতাদির চৌধুরীর দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বকে পুঁজি করেই কোনো পক্ষ এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে স্থানীয়দের দাবি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নাসিরনগরের দাক্ষিণপাড়ার এক বাসিন্দা জানান, হিন্দু বাড়িঘর ও উপাসনালয়ে হামলার ঘটনায় জড়িত আসল হোতারা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কোন্দলের ফলে এটি ঘটলেও এটিকে রাজনৈতিক রঙ দেয়া হচ্ছে। এ কারণেই তিন দফায় হামলার সুযোগ পেয়েছে দুর্বৃত্তরা। ঢাকাটাইমস