নওগাঁ প্রতিনিধি : নওগাঁর রাণীনগর সমাজ সেবা কার্যালয়ে টাকা দিলেই পাওয়া যায় বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতার কার্ড। টাকা দিলে বয়স্কও হওয়ার দরকার নেই, বিধবাও হওয়ার প্রয়োজন নেই!
সরকারি বিধি মোতাবেক, পুরুষের ক্ষেত্রে ৬৫ বছর এবং নারীদের ক্ষেত্রে ৬২ বছরের নিচে কেউ বয়স্ক ভাতা পাওয়ার যোগ্য নন। কিন্তু এখানে তাও মানা হচ্ছে না। এই সুবিধা পাবার কথা সমাজের অসহায় ও দরিদ্র মানুষদের। কিন্তু বেশির ভাগ স্বচ্ছল মানুষই ভোগ করছেন এসব সুবিধা।
অভিযোগ উঠেছে, রানীনগর উপজেলার সমাজসেবা কার্যালয়ের ইউনিয়ন সমাজকর্মী নাসরিন পারভীন দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তুলেছেন একটি সিন্ডিকেট চক্র। এ চক্রে ইউনিয়ন পরিষদের একাধিক চেয়ারম্যান ও সদস্যও জড়িত আছেন। ওই চক্রের পছন্দমতো ব্যক্তিদের অর্থের বিনিময়ে দেওয়া হয় এই সব ভাতার কার্ড। পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা দিলেই বিধবা না হলেও বিধবা ভাতার এবং বয়স না হলেও বয়স্ক ভাতার কার্ড পাওয়া যায় বলে অভিযোগ উঠেছে।
টাকা না দিলেই হয়রানির শিকার হতে হয় সহায়তা নিতে আসা মানুষদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যরা বলেন, ‘আমরা কী করব? সমাজসেবা কার্যালয়ে টাকা না দিলে কোন কাজ হয় না। আর টাকা না দিলেই দেখায় হাজারটা অজুহাত। তাই আমরা বাধ্য হয়েই দরিদ্র মানুষদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাঁদের ভাতার ব্যবস্থা করে দেই।’
বিভিন্ন গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, একই পরিবারের সব সদস্য দীর্ঘদিন ধরে কোন না কোনো ভাতার সুবিধা ভোগ করছেন। বয়স্কভাতা পাওয়ার যোগ্য বড় ভাইকে বাদ দিয়ে টাকার বিনিময়ে ছোট ভাই পাচ্ছেন বয়স্ক ভাতার টাকা। এমনও পরিবারে দেখা গেছে স্বামী পাচ্ছেন বয়স্কভাতা একই সঙ্গে স্ত্রীও পাচ্ছেন বিধবা ভাতার টাকা। কেউ প্রতিবন্ধী কিংবা পঙ্গু না হলেও পাচ্ছে প্রতিবন্ধী ভাতার সুবিধা।
উপজেলা সদরের পশ্চিম বালুভরা গ্রামের মোট ৭০ টি পরিবারের মধ্য ৩৫ থেকে ৪০টি পরিবারই বয়স্ক কিংবা বিধবা ভাতার সুবিধা ভোগ করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এসব পরিবার আর্থিকভাবে স্বচ্ছল। তাঁদের বসতবাড়ি পাকা করা।
পশ্চিম বালুভরা গ্রামের পবন আলীর (মৃত) ছেলে ময়েজ উদ্দিনের বয়স মাত্র ৩৫ বছর। ময়েজ উদ্দিন দীর্ঘদিন ধরে বয়স্কভাতা নিচ্ছেন। একই গ্রামের আজিজার রহমান (৫০), মখলেছুর রহমানের স্ত্রী মর্জিনাসহ (৪০) অনেকেই টাকা দিয়ে বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতার কার্ড করে নিয়েছে।
একই গ্রামের আফতাব হোসেন (৫০) পাচ্ছেন বয়স্কভাতা ও তার স্ত্রী মাজেদা (৪০) পাচ্ছেন বিধবা ভাতার টাকা। একই গ্রামের বৃদ্ধ গফুর শাহ (৭৭) বলেন, ‘আমার আগে আমার মেয়ে কী করে বয়স্কভাতা পায়? আমি সমাজ সেবা অফিসের নাসরিন পারভীনের কাছে সাত হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে বয়স্কভাতার কার্ড পেয়েছি। কিন্তু এখনো আমি বয়স্কভাতার টাকা হাত দিয়ে স্পর্শ করতে পারিনি। নাসরিন আমার ভাতার টাকা থেকে তার ঘুষের টাকা কেটে নিয়েছে।’
একই গ্রামের মোজাফ্ফর হোসেন ( ৬৫) বলেন, ‘বেশ কয়েকবার আমি সমাজসেবা অফিসের নাসরিনের কাছে গিয়েছি কিন্তু কাজ হয়নি। সে আমার কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ চায় কিন্তু আমি গরিব দিনমজুর। এত টাকা ঘুষ দিব কীভাবে। তাই আমার কার্ড হয়নি। অথচ আমার ছোট ভাইয়েরা মেম্বারকে ঘুষ দিয়ে বয়স্কভাতার কার্ড করে নিয়েছে।’
উপজেলার কাশিমপুর ইউনিয়নের চকাদিন হিন্দুপাড়ার দিনমজুর শরিফুল ইসলামের শারীরিক প্রতিবন্ধী মেয়ে মোছা. মুহিনি আক্তার (৮) আট বছর পার হলেও আজ পর্যন্ত কোনো প্রতিবন্ধী ভাতা পায় না। একই গ্রামের কমল কুমার দাস (২৮) ও সিমা দাস (২৪) দুই ভাই বোনই জন্ম থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধী। সম্প্রতি কমল কুমার দাস প্রতিবন্ধীভাতা পেলেও সিমা দাস এখন পর্যন্ত কোনো সুযোগ-সুবিধা পায় না।
‘উপরের মহলকে ম্যানেজ করা’
একই চিত্র উপজেলার অন্যান্য গ্রামগুলোতেও। সমাজ সেবা কার্যালয় এখন পুরো উপজেলায় ‘নাসরিনের অফিস’ নামেই সবার কাছে পরিচিত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কার্যালয়ে কর্মরত একাধিক কর্মচারী
জানান, কোনো ভালো কর্মকর্তা এসে এই নাসরিন ও তার সিন্ডিকেটের কাছে টিকতে পারে না। তারা ওপর মহলকে ‘ম্যানেজ’ করে এখানে দীর্ঘদিন ধরে দরিদ্র মানুষের রক্ত চুষে চাকরি নামের এই বাণিজ্য করে আসছেন।
এই বিষয়ে সমাজ সেবা কার্যালয়ে ইউনিয়ন সমাজকর্মী মোছা. নাসরিন পারভীন বলেন, ‘প্রতিটি ইউনিয়নে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যানের প্রতিনিধিদল আছে। সেই দল আমাদের কাছে যে তালিকা দেয় সে অনুসারে আমরা কার্ড বিতরণ করি। তাদের দেওয়া তালিকা যাচাই-বাচাই করার অধিকার আমাদের নেই। আর অফিসে যা কিছু হয়ে থাকে তা এই অফিসের সবাই জানে।’
উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হারুনুর রশিদ বলেন, ‘নাসরিন পারভীন একজন অসৎ, লোভী ও দুর্নীতিবাজ কর্মচারী। তার কাছে আমরা জিম্মি হয়ে পড়েছি। উপজেলা পরিষদের একাধিক সমন্বয় সভায় এই নারীকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। সে এখানে দীর্ঘদিন চাকরি করার কারণে এসব আত্মীয়করণ করার সুযোগ পাচ্ছে।’
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান বলেন, ‘এই সব অনিয়ম-দুর্নীতি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। আমি অফিসের কর্মচারীদের হাতে জিম্মি। তাদের এসব কাজ আমি করতে না চাইলে তারা আমাকে বিভিন্ন রকমের হুমকি-ধমকি ও ভয়ভীতি দেখায়। আমার চেয়ার ঠিক রাখা ও ভালোভাবে চাকরি করার সুবাদে আমি একা তাদের সঙ্গে পেরে উঠতে পারি না।’
আনিছুর রহমান আরো বলেন, ‘এই অফিসে তারা দীর্ঘদিন ধরে চাকরি করার কারণে প্রতিটি ইউনিয়নে গড়ে তুলেছে মেম্বার, চেয়ারম্যান ও স্থানীয় নেতাদের সহযোগিতায় একটি চক্র যাদের দ্বারা তারা এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি করে আসছে।’ সূত্র: এনটিভি অনলাইন