নিউজ ডেস্ক : ছররা গুলিতে জখম বাঁ চোখ। এই চোখে আর কোনো দিন দেখতে পারবেন কি না নিশ্চয়তা নেই। তবুও ঘাবড়াননি দ্বিজেন টুডু (৩৭)। নিয়তি কি মেনে নিয়ে তিন শিশু সন্তানের জন্য বেঁচে থাকতে চান।
তাই দ্বিজেনের একটিই চাওয়া- মাথা, পিঠ, কোমড় এবং পায়ে লেগে থাকা অসংখ্য ছররা গুলি বের করে দিয়ে তাকে যেন সুস্থ করে দেয়া হয়। যেন গ্রামে ফিরে তিনি আগের মতো খেতমজুরের কাজ করে সন্তানের মুখে ভাত তুলে দিতে পারেন।
গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রংপুর চিনিকল এলাকার মাদারপুর গ্রামে নিবাসী দ্বিজেন টুডু। গুলিবিদ্ধ চোখ নিয়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে তিনি ভর্তি আছেন রাজধানীর আগারগাঁওয়ের জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের ৪২৬ নম্বর ওয়ার্ডে।
শনিবার সন্ধ্যায় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে দ্বিজেন তার শরীর থেকে গুলি বের করার মিনতি ছিলেন। এ সময় পাশে ছিলেন ভাইয়ের চিকিৎসায় সহযোগিতা করতে আসা বোন মারথা টুডু (৩৩)।
মারথা টুডু জানান, হাসপাতাল থেকে দ্বিজেনকে যে খাবার দেয়া হয় তাই দুই ভাইবোন ভাগ করে থাকেন। ফলে গত ছয় দিন ধরেই আধপেটা অবস্থায় আছেন তারা।
কী ঘটেছিল সেদিন
দ্বিজেন বলেন, ‘গত ৬ নভেম্বর সকাল ১০টার দিকে মাদারপুরের চারটি গ্রামের সাড়ে তিন হাজার সাঁওতাল এবং এক হাজার তিনশ’ বাঙালির ওপর অতর্কিত হামলা চালানো হয়।’
তিনি বলেন, হঠাৎ করে হামলা হওয়ায় গ্রামবাসীরা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। অনেকেই পালাতে চেষ্টা করলেও তিনি তা করেননি। বরং শত শত শিশু ও নারীর কথা বিবেচনা করে হামলা না করার আবেদন জানাতে হামলাকারীদের দিকে খালি হাতে এগিয়ে যান দ্বিজেন। ২০ গজের মতো যাওয়ার পর তাকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো ছররা গুলি ছোঁড়া হয়।
চোখ ও মাথায় গুলি লাগার পর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন দ্বিজন। এরপরও তার পিঠ ও কোমর লক্ষ্য করে গুলি করা হয় বলে জানান তিনি। এক পর্যায়ে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন।
মারথা বলেন, দ্বিজেন যখন গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন, তখন দূর থেকে এই দৃশ্য দেখেন তারা। কিন্তু গুলি ভয়ের তারা কেউ সামনে এগোতে পারেননি। ভেবেছিলেন, তিনি হয়তো মারা গেছেন।
কিন্তু এসময় ১৪ বছর বয়সী একজন সাঁওতাল কিশোর গুলি উপেক্ষা করেই এগিয়ে গিয়ে দ্বিজেনকে উদ্ধার করে স্বজনদের কাছে নিয়ে আসেন।
হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে
মারথা জানান, ছররা গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত দ্বিজেনকে নিয়ে বেবিট্যাক্সিতে করে তারা প্রথমে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলায় যান। কিন্তু সেখানে চিকিৎসা না পেয়ে তারা পার্বতীপুর উপজেলার খ্রিস্টান মিশনারিদের ল্যাম্ব হাসপাতালে যান।
গুলিবিদ্ধ হওয়ায় দ্বিজেনকে সেখানে চিকিৎসা দেয়া যাবে না বলে জানানো হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে বলেন।
মারথা বলেন, ৬ নভেম্বর রাত ১০টায় দ্বিজেনকে রংপুরে নেয়া হয়। সেখানে তার মুখ থেকে ছররা গুলি বের করা হয়। কিন্তু বাঁ চোখে বিদ্ধ হওয়া বুলেট বের করতে না পেরে তাকে ঢাকার চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।
গোবিন্দগঞ্জের সংঘর্ষের ঘটনায় রংপুর মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই দ্বিজেনকে গ্রেফতার দেখানো হয়। এ কারণে গাইবান্ধা পুলিশ লাইন থেকে তিনজন পুলিশ সদস্যকে এনে তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়।
গত ৮ নভেম্বর রাত ৩টায় ঢাকার চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে পৌঁছান দ্বিজেন, মারথা ও তিন পুলিশ সদস্য।
গুলি বের করে দেন
দ্বিজেন বলেন, তিনি একজন খেতমজুর। বাড়িতে স্ত্রী উলিবিয়া হেমব্রম এবং তিন সন্তান ইলিয় টুডু (১১), মারফিলি টুডু (৭) ও জিসায়েল টুডু (আড়াই বছর) রয়েছে। এছাড়াও আছেন বাবা-মা।
অন্যের কৃষি জমিতে কাজ করে এ সাত জনের সংসার চালান একমাত্র উপার্জনক্ষম দ্বিজেন।
দ্বিজেন প্রতিবেদকে তার শরীরের বিভিন্ন অংশে ছররা গুলির দাগ দেখান। বলেন, সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। উঠতে বসতে প্রচণ্ড কষ্ট হয়।
গুলি লাগায় বাঁ চোখে আর দেখতে পাবেন না জানিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন দ্বিজেন। তিনি বলেন, ‘ভাই ডান চোখটা যদি টিকে তাহলে হয়তো দেখতে পাব, কাজ করে সংসারটা চালাতে পারব।’
ডান চোখে গুলি লেগেছে কি না জানতে চাইলে দ্বিজেন না বলে উত্তর দেন। তবে তিনি জানান, ডান চোখের ওপরে কপালে অনেকগুলি গুলি ছররা গুলি লাগায় ঝাপসা দেখছেন।
ডান চোখে দেখতে না পেলে তার সংসারে দুর্যোগ নেমে আসবে বলে কেঁদে ফেলেন দ্বিজেন। এ সময় তিনি মিনতি জানিয়ে বলেন, তার শরীরের গুলিগুলোবো যেন বের করে দেয়া হয়। তিনি যেন আগের মতোই খেতমজুরের কাজ করতে পারেন।
চিকিৎসা নিয়ে সংশয়
মারথা বলেন, তার ভাইয়ের সঠিক চিকিৎসা নিয়ে সংশয়ে আছেন তিনি। এর কারণে জানতে চাইলে দ্বিজেনর পাশের তিনটি শয্যায় থাকা তিন পুলিশ সদস্যকে দেখান তিনি।
এরপর ফিসফিস করে তিনি বলেন, প্রশাসনের এই লোকেরা বলেছে আমার ভাইয়ের চোখে নাকি গুলি নাই। ভাই নাকি সুস্থ হয়ে গেছে। ডাক্তারের কাছ থেকে বলে তাকে গাইবান্ধা নিয়ে যাবে।
মারথা জানান, ব্যথার কারণে তার ভাইয়ের শুয়ে বসে থাকতে কষ্ট হলেও রাতে তাকে হাতকড়া পরিয়ে এবং কোমরে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখেন পুলিশ সদস্যরা। এতে ভাইয়ের কষ্ট বাড়ে বলে জানান তিনি।
গত ৮ নভেম্বর থেকে ভাইয়ের সঙ্গে চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউটে আছেন মারথা। কিন্তু গত ছয় দিনে এক বেলাও খাবার পাননি তিনি। প্রতিদিন সকালে দুটি ছোট রুটি, দুপুর ও রাতে এক প্লেট করে স্বল্প পরিমাণে ভাত দেয়া হয়। সেই খাবার থেকেই কিছু অংশ খেয়েই গত ছয়দিন কেটেছে বলে জানান মারথা।
দ্বিজেনকে পাহারা দিচ্ছেন গাইবান্ধা পুলিশ লাইনের নায়েক আশরাফুল ইসলাম এবং কনস্টেবল রেজাউল ইসলাম ও আশিক কুমার।
নায়েক আশরাফুল বলেন, গোবিন্দগেঞ্জর সংঘের্ষর ঘটনায় দ্বিজেনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তারা দ্বিজেনকে পাহারা দিচ্ছেন। চিকিৎসকরা ছাড়পত্র দিলে তাকে গাইবান্ধা নিয়ে যাওয়া হবে।
দ্বিজেনের চিকিৎসার জন্য ডা. গোলাম হায়দারের নেতৃত্বে একটি পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট মেডিকেল বোর্ড গঠন করেছে চক্ষুবিজ্ঞান ইইন্সটিটিউট।
বোর্ডের অন্যতম সদস্য এবং দ্বিজেনের চিকিৎসার দায়িত্বপ্রাপ্ত ডা. সাইফুদ্দিন আহমেদ পিন্টু বলেন, দ্বিজেন টুডুর বাঁ-চোখ ছররা গুলিবিদ্ধ হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এ চোখটি দিয়ে দ্বিজেন আর দেখতে পারবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবস্থা গুরুতর হওয়ার কারণেই মেডিকেল বোর্ড গঠন করে চিকিৎসা চলছে।
তবে চিকিৎসা সম্পন্ন না হওয়ার পর্যন্ত দ্বিজেনকে চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউটে রাখা হবে বলে জানান ডা. পিন্টু। যুগান্তর