নিজস্ব প্রতিবেদক : ‘আমাগো বইখাতা আছে। ইসকুল ঘর নাই। এ্যাহোন আমরা গাছতলায় মাটিতে বইসা কেলাস করি। আমাগো খুব কষ্ট হয়। সারেরাও কইতে পারে না কবে ইসকুল ঘর হইবো।’
কথাগুলো ডালিয়ার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সিলট্রাপে আশ্রয় নেয়া আব্দুল করিমের মেয়ে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী ইয়াছমিনের। সেখানে আশ্রয় নেয়া চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী সীমা আক্তার, দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র জহুরুল, চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র আরিফ, তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র মিলন এবং কলম্বিয়া বাঁধে আশ্রয় নেয়া পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী মমেনা, ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ইসমত আরার মুখেও একই কথা।
বন্যার পানিতে বিদ্যালয় বিলীন হয়ে গেলেও পড়াশোনা থেমে নেই নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার সাতটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় চার হাজার শিক্ষার্থীর। গেল আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে তিস্তা ব্যারেজের সিলট্রাপে খোলা আকাশের নিচে গাছতলায় চলছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাঠদান কার্যক্রম।
জুনের শেষ দিক থেকে আগস্টের শেষ পর্যন্ত এক মাসের বন্যার পানিতে বিলীন হয়ে যায় নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের চরখড়িবাড়ি গ্রামের চরখড়িবাড়ি, জিঞ্জিরপাড়া, পূর্ব খড়িবাড়ি হায়দার পাড়া, পূর্বখড়িবাড়ি, চরখড়িবাড়ি বাবুপাড়া, চরখড়িবাড়ি মধ্যপাড়া এবং সোহরাব হোসেন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। এসব বিদ্যালয়ে বন্যার সময় থেকে বন্ধ থাকে পাঠদান কার্যক্রম। বাধ্য হয়ে শিক্ষা বিভাগের উদ্যোগে অস্থায়ী ভিত্তিতে সিলট্রাপ, গাইড বাঁধ, গ্রোয়েন বাঁধ, স্পারসহ উঁচু স্থানে চালানো হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম।
সিলট্রাপে আশ্রয় নেয়া টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের জিঞ্জিরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র ইসমাইল হোসেন বলল, ‘আমাদের বাড়িঘর বানের পানিতে ডুবে গেছে। বাবা-মা এখানে থাকছে। স্যারেরা এখানে আমাদের ক্লাস নিচ্ছেন। রোদবৃষ্টির ভয়ে ভালোমতো পড়াশোনা করা যায় না এখানে।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, তিস্তা ব্যারেজ সংলগ্ন সিলট্রাপে আশ্রয় নিয়েছে ১২০০ পরিবার। সেখানকার শিক্ষার্থীদের অস্থায়ী ভিত্তিতে গাছতলায় পাঠদান করানো হচ্ছে শিক্ষা বিভাগের উদ্যোগে।
অভিভাবক শফিকুল ইসলাম বলেন, বাড়িঘর, আবাদী জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পাশের স্কুল ভেঙে পানিতে ডুবে যাওয়ায় সেখানে পড়াশোনা বন্ধ। বাধ্য হয়ে সিলট্রাপে আশ্রয় নেয়া শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন শিক্ষকরা। তবে শিশুদের পড়াশোনায় মনোযোগ নেই বলে জানান তিনি।
জিঞ্জিরপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রেজাউল করিম বলেন, ‘সিলট্রাপে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা রয়েছে। তাদের সবাইকে দুই শিফটে আমরা পাঠদান করছি। চারজন শিক্ষক এখানে দায়িত্ব পালন করছেন।’ তবে শিক্ষা উপকরণের অভাবে পাঠদানে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটছে বলে জানান তিনি।
টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম শাহিন বলেন, বন্যার পানির তোড়ে দুই হাজার পরিবারের বসতভিটা, আবাদী জমি বানের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রক্ষা পায়নি সাতটি বিদ্যালয়ও। ওইসব বিদ্যালয় পুরোপুরি পড়াশোনার অযোগ্য হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে উঁচু স্থানে পাঠদানের ব্যবস্থা করা হয়।
তবে পাঠদান প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখতে যত দিন না পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় ততদিন পর্যন্ত উঁচু স্থানে পাঠদান চালানো হবে জানিয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা দিলীপ কুমার বণিক জানান, শিক্ষার বাহিরে রাখা যাবে না শিক্ষার্থীদের। এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে দফতরটি। গাছতলায় পাঠদান চললেও শিক্ষার্থীদের দেয়া হচ্ছে টিফিন। বইখাতা সরবরাহসহ অস্থায়ী ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কেন্দ্রগুলোতে সার্বিকভাবে সহায়তা করা হচ্ছে বলে জানান এই জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা।
তবে বাংলাদেশ-ভারত শূন্য পয়েন্টে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আফতাব উদ্দিন সরকার।
তিনি জানান, বাঁধটি নির্মিত হলে ওই এলাকার অন্তত ১০ হাজার মানুষ উপকৃত হবে। বাঁচবে আবাদী জমি, বসতঘর আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।