বিরোধীরা ছন্নছাড়া ও নেতৃত্ব দ্বন্দ্বে, ক্ষমতাসীনরা টানা তৃতীয় জয়ের মিশনে
দরজায় কড়া নাড়ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ডিসেম্বরের ২৭ তারিখ ভোট গ্রহণ নির্ধারণ করা হয়েছে বলে নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে। ভোট গ্রহণ তারিখ চূড়ান্ত হলেও রাজনীতিকরা বর্তমানে সরব ইলেট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) বিতর্কে। তবে সার্বিক পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে নির্বাচন যে প্রক্রিয়ায়ই হোক বিরোধীদের তুলনায় ক্ষমতাসীনরা ভোটে অংশগ্রহণের প্রস্তুতিতে অনেক এগিয়ে।
বিরোধী শিবিরের প্রধান শরিক বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটসহ সংসদের বাইরে অন্যান্য বিরোধী দল ও জোটের নেই কোনো জোর প্রস্তুতি। বরং তাদের মধ্যে চলছে সমন্বহীনতা। কে কার সঙ্গে জোটবদ্ধ হবে সে ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি নেই, শুধুই চলছে নেতৃত্ব বাছাইয়ের প্রতিযোগিতা।
আর বিরোধীদের এমন ছন্নছাড়া পরিস্থিতির মধ্যে ক্ষমতাসীনরা প্রস্তুতি চালাচ্ছে টানা তৃতীয় দফা জয় নিশ্চিতের। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি এবং জামায়াত বাদে অন্যান্য ইসলাম ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের মধ্যে চলছে নির্বাচনে অংশ গ্রহণের নানা কৌশল।
বিএনপি রীতিমতই কাতর দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানকে নিয়ে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও দুর্নীতির নানা অভিযোগে জিয়া পরিবারসহ অন্যান্যরা আদালতে দৌঁড়ঝাঁপেই ব্যাস্ত। তাছাড়া জোটের অপর মিত্র বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি ও দলের নিবন্ধন বাতিলে অস্তিত্ব সংকটে।
অন্যদিকে জামায়াতের ব্যাপারে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও বিশ্ব পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ যে, দলটি ইসলামী ইসলামী মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদকে উস্কে দিচ্ছে।আর এ কারণে জামায়াতকে নিয়েও চাপে রয়েছে বিএনপি।
মূলত দুটি কারণ, এক জামায়াত ইস্যু ও দ্বিতীয়টি হচ্ছে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের জন্যই বিএনপি জোটবদ্ধ হতে পারছে না যুক্তফ্রন্টের সাথে। যুক্তফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের মধ্যে চলছে পরস্পর বিরোধী অভিযোগ।
ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে বেঈমান আখ্যায়িত করে তার উপর আস্থা না রাখতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে কড়া নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে রাখলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে কোনো ঐক্য হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে যুক্তফ্রন্ট নেতৃত্ব।
তবে জামায়াত ও বিএনপি সূত্র এই প্রতিবেদককে জানিয়েছে, জামায়াত ইস্যুকে কৌশলে চলিয়ে নেয়া হবে। যেহেতু জামায়াতের রেজিষ্ট্রেশন ও প্রতীক আপাতত নেই, তাই আসন্ন নির্বাচনে জোটগত নির্বাচন হলে জামায়াত প্রার্থীরা অতীতের মতো বিএনপির দলীয় প্রতীক ধানের শীষ নিয়েই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে।এক্ষেত্রে যুক্তফ্রন্টের নেতারা ২০ দলীয় জোটের বিরুদ্ধে মৌলবাদ ও যুদ্ধাপরাধ তকমা আর ব্যবহার করতে পারবে না।
ক্ষমতাসীন জোটের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কয়েক দফা চেষ্টা করছে যুক্তফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোট।ঐক্য প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্যে সর্বশেষ গত মঙ্গলবার গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের বাসায় বৈঠকে মিলিত হন তিনিসহ বিকল্পধারার সভাপতি ডা. এ কিউ এম বদরদ্দোজা চৌধুরী, বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি মহাসচিব আবদুল মান্নান, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আব্দুর রব, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিত গণস্বাস্থ্যের ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রমুখ।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আলোচনায় আ স ম আব্দুর রব বলেছেন যুক্তফ্রন্টের ভোট ব্যাংক খুবই নগন্য। তাই নির্বাচনে ইতিবাচক ফলাফল আনতে হলে একটি বড় দলকে যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে ভেড়াতে হবে।
তিনি বলেন, ‘ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিবেচনার বাইরে। তাহলে বাকি থাকলো বিএনপি। বিএনপিকে সঙ্গে না রাখতে পারলে নির্বাচনে জয় তো দূরে থাক সম্মানজনক হারের সম্ভাবনাও শূন্য।
তাই বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলকে যুক্তফ্রন্টে আনার সুপারিশ করেন তিনি। আবার জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের মত সাম্প্রদায়িক দল বা গোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করলে যুক্তফ্রন্টের ইমেজও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এ সময় নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, অবশ্যই তারা বিএনপির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হবেন। ২০ দলীয় জোট ঐক্যে এলো কী এলো না তাতে কিছু আসে যায় না। বিএনপি এককভাবে আসলেও তাদের সঙ্গে ঐক্য করা হবে বলে জানান তিনি। এই পর্যায়ে জামাতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করা হবে নাকি জামায়াতকে বাদ দিয়ে ঐক্য করা হবে এ বিষয়ে বৈঠকে উপস্থিত নেতাদের মধ্যে বিতর্ক হয়। কামাল হোসেন এসময় বিএনপির সঙ্গে কথা বলার প্রস্তাব দেন।
ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘আগে বিএনপির মনোভাব কী জানা প্রয়োজন। বিএনপি কী করতে চায় তা আগে জানতে হবে। বিএনপির মনোভাব জানার পর দলটির সঙ্গে ঐক্যের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান ড. কামাল।’
ওই বৈঠকে এরপর সিদ্ধান্ত হয় বদরুদ্দোজা চৌধুরী, মাহমুদুর রহমান মান্না ও ড. জাফর উল্লাহ বিএনপির জ্যেষ্ঠ ও দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলবেন। শিগগিরই তারা বিএনপির সঙ্গে ঐক্যপ্রক্রিয়ার বিষয়ে আলোচনায় বসবেন বলেও বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়।
অন্যদিকে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠন নিয়ে উদ্বিগ্ন ক্ষমতাসীন ১৪ দল ও সংসদে বর্তমান প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের এক প্রেসিডিয়াম সদস্য এই প্রতিবেদককে বলেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে ১৪ দল ও জাতীয় পার্টি মিলে আবারো মহাজোট এবং জামায়াতকে মোকাবিলা করতে হেফাজতসহ বিভিন্ন উদার ইসলামপন্থী দলগুলোকে রাখা হবে।
‘যদি বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেয় তবে ১৪ দলের বাইরে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও ইসলামপন্থী দলগুলোকে দিয়ে আলাদা একটি জোট গঠন করিয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আদলে নির্বাচন হবে,’ বলেন আওয়ামী লীগের এই নেতা।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘ড. কামাল হোসেন সাহেব এর আগেও বহুবার জোট করেছেন, ভেঙেও ফেলেছেন। তার জোটে কখনও জনসমর্থন জোটেনি।’
‘নির্বাচনের আগ মুহূর্তে তাদের নতুন জোট গঠনের কারণ ও লক্ষ্য দেশের মানুষের বুঝতে আর বাকি নেই। প্রতি নির্বাচনেই তারা এরকম জোট গঠন করে তাদের নির্বাচনি মূল্য বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে থাকে। এবারও তা-ই করছে। এতে তাদের খুশি হওয়ার কোনও সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না,’
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ১৪ দলের সমন্বয়ক মোহাম্মদ নাসিমও যুক্তফ্রন্ট্রের জোট গঠন প্রক্রিয়াকে বালির বাঁধের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট আবারও জয়ী হবে বলেও তিনি ঘোষণা দিয়েছেন।
তবে বিএনপির মহাসচিব প্রতি নিয়তই বলছেন দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না। এছাড়া ৫ জানুয়ারি ধরণের নির্বাচন ক্ষমতাসীনরা করতে গেলে তা প্রতিহত করা হবে বলেও তিনি হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির এক জ্যেষ্ঠ নেতা তারেক রহমানের নির্দেশনার কারণেই যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে বিএনপির জোট গঠনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে বলে জানান।