ষষ্ঠবারের মতো পুনর্গঠনের অপেক্ষায় ট্রাইব্যুনাল
নিজস্ব প্রতিবেদক: একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারপতি না থাকায় মামলার বিচারিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।
তবে, আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, খুব কাছাকাছি সময়ের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হবে। এরপর ট্রাইব্যুনালের স্থবিরতা কেটে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এটি নিয়ে ষষ্ঠবারের মতো ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হবে।
ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন না হওয়া পর্যন্ত মামলা পরিচালনা করতে পারলেও আসামির বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ (অনুষ্ঠানিক অভিযোগ) গঠন এবং মামলার রায় ঘোষণা করতে পারছেন না আদালত। কারণ ট্রাইব্যুনালের বিধি অনুযায়ী, তিনজন সদস্যের বিচারিক প্যানেল মামলার বিচার কাজ পরিচালনা করবেন। সেখানে একজন সদস্য না থাকলে বিচারিক কাজ পরিচালনা করতে পারবেন না আদালত।
ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারক মো. আবু আহম্মেদ জমাদারকে হাইকোর্টের অস্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। গত ৩০ মে হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগ দেয়ার পরের দিন অর্থাৎ ৩১ মে থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার কার্যক্রম স্বাভাবিক নিয়মে চলছে না।
ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের বিষয়ে রেজিস্ট্রার প্রশান্ত কুমার চক্রবর্তী জাগো নিউজকে বলেন, আশা করছি খুব শিগগিরই ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হবে। ঈদুল ফিতরের আনুষ্ঠানিকতার জন্য গঠন প্রক্রিয়া এখনও হয়ে ওঠেনি। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে এটি পুনর্গঠন করা হবে।
এ বিষয়ে প্রসিকিউশন টিমের অন্যতম সদস্য প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, ট্রাইব্যুনাল দ্রুত সময়ের মধ্যে পুনর্গঠন হওয়া দরকর। এখন অনেকগুলো মামলা পেন্ডিং আছে। আশা করছি অল্প সময়ের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হবে।
প্রসিকিউটর জিয়াদ আল মালুম জাগো নিউজকে বলেন, ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন না হওয়াতে বিচারকাজ সাময়িক স্থবির আছে। আমরা প্রত্যাশা করছি শিগগিরই এটি পুনর্গঠন হবে। এই স্থবিরতা সাময়িক। পুনর্গঠনের পর স্থবিরতা কেটে যাবে।
তিনি জানান, বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে ৩৩টি মামলা বিভিন্ন পর্যায়ে বিচারাধীন। এর মধ্যে একটি মামলার রায় ঘোষণার জন্য সিএভি (অপেক্ষাধীন) রাখা হয়েছে। অর্থাৎ যে কোনো দিন এ মামলার রায় ঘোষণা হবে। ট্রাইব্যুনালে যদি এখন নতুন করে বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয় তাহলে পুনরায় এ মামলার যুক্তিতর্ক শুনানি করতে হবে।
ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের বিষয়ে তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এম. সানাউল হক বলেন, ট্রাইব্যুনাল গঠন স্বাভাবিক (ন্যাচারাল) প্রক্রিয়ার বিষয়। একজন বিচারক হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় বর্তমানে ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম স্থবির রয়েছে। চলমান কিছু মামলা রয়েছে, আশা করছি খুব শিগগিরই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে।
গত ৩০ মে সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদের প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ হাইকোর্ট বিভাগে ১৮ জন অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগ দেন। ওই দিন সন্ধ্যায় আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক স্বাক্ষরিত ১৮ জন অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
১৮ বিচারপতির মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সদস্য (সাবেক জেলা জজ) মো. আবু আহম্মেদ জমাদারকেও হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ৩১ মে বিচারপতি আবু আহম্মেদ জমাদারসহ হাইকোর্টে নিয়োগ পাওয়া ১৮ জন বিচারপতিকে শপথ পাঠ করান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।
এর আগে, ২০১৭ সালের ১১ অক্টোবর সর্বশেষ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। ২০১৭ সালের ১৩ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন বিচারপতি মো. আনোয়ারুল হক চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। দীর্ঘ ৯১ দিনের মাথায় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামকে নিয়োগ দেয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। এরপর ট্রাইব্যুনালের পঞ্চম চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম। অন্যদিকে, ট্রাইব্যুনালের সদস্য হিসেবে হাইকোর্টের বিচারপতি আমির হোসেন ও বিচারক মো. আবু আহমেদ জমাদারকে বিচারিক প্যানেলের সদস্য করা হয়।
২০১০ সালের ২৫ মার্চ পুরাতন হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তখন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় বিচারপতি মো. নিজামুল হক নাসিমকে।
২০১২ সালের ২২ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরও একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। সেখানে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় হাইকোর্টের বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরকে।
২০১৩ সালের ১৩ অক্টোবর দুই ট্রাইব্যুনালই পুনর্গঠন করা হয়। ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবিরের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় অবসর গ্রহণ করেন।
২০১৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম। সদস্য করা হয় বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি আনোয়ারুল হককে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান করা হয় বিচারপতি মো. ওবায়দুল হাসান শাহীনকে। সদস্য করা হয় বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিঞা ও বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামকে।
পরবর্তীতে ট্রাইব্যুনালের মামলার সংখ্যা কমে যাওয়ায় ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর একটি আদালত বিলুপ্ত করে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। তখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একটি করা হয়।
২০১৫ সালের একটি ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান করা হয় বিচারপতি আনোয়ারুল হককে। এরপর বিচারপতি আনোয়ারুল হক চিকিৎসাধীন অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে মারা যান। তখন বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামকে চেয়ারম্যান করে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়।
প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৬৩টি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এসব রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে খালাস চেয়ে আসামিদের পক্ষ থেকে আপিল আবেদন করা হয়। মোট সাতটি মামলায় আপিল নিষ্পত্তির পর সর্বশেষ রিভিউ আবেদনেরও নিষ্পত্তি করা হয়।
গোলাম আযম ও আব্দুল আলিমের দুই মামলায় আপিল আবেদনের বিচার চলার সময় আসামিরা মারা যান। তাদের আপিল আবেদনও নিষ্পত্তি করা হয়। এর মধ্যে আপিল বিভাগে যাবজ্জীবন দণ্ড থেকে আব্দুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড, মো. কামারুজ্জামান, আলী আহসান মো. মুজাহিদ, সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী, মতিউর রহমান নিজামী ও মীর কাসেম আলীসহ ৬টি মামলায় মৃত্যুদণ্ড এবং অপর আসামি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড থেকে অমৃত্যু কারাদণ্ড ঘোষণা করা হয়।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে দণ্ড পাওয়ার পর ওই রায়ের বিরুদ্ধে করা আরও ২০টির মতো আপিল আবেদন এখনও নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। জাগো নিউজ