মুমিন একে অপরের বন্ধু
মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী : প্রযুক্তিময় এই পৃথিবীর মানুষ আরাম আয়েশ পেয়ে সময় যেন ফুরোয় না তাদের। তাই এক মানুষকে অন্য মানুষের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছে মারণাস্ত্র দিয়ে। মানুষ যখন মানুষকে মারছে তখন তারাই আবার সুবিধা বুঝে পক্ষ নিচ্ছে! এভাবেই আজকের প্রযুক্তির দুনিয়ার মানুষ মজা লুটছে, ফায়দা নিচ্ছে! বিশ্ববাসীর শান্তির পথ খুঁজছে না কেউ। কেউ ভাবছে না বিশ্ব নৌকাটা কোথাও ফুটা হলে আস্তে আস্তে গোটা মানব গ্রহ ডুবে যাবে! বড়ই আফসোস। ঐশীগ্রন্থ কুরআনের ধারক-বাহক যারা, তারাও এখন ঘুমিয়ে নাক ডাকাচ্ছে। হায়! আবার কবে জেগে উঠবে মুসলমান। তারাই আবার কুরআনের আলোয় জগৎবাসীকে এক কাতারে দাঁড় করাতে পারে।
তখনো আরবের আঁধার কাটেনি। সামান্য ব্যাপারেই প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে যুদ্ধংদেহী আরবরা উন্মুক্ত তরবারি নিয়ে দাঁড়িয়ে যেত শত্রুর বিরুদ্ধে। উটের পানি পান আগ-পিছু হওয়ার মতো তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের যুদ্ধ লেগে যেত আরব গোত্রগুলোর মধ্যে। যুদ্ধ চলত বছরের পর বছর।
আরবের ক্ষমতাধর থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত মেতে উঠত রক্তের হোলিখেলায়। এমন একটি রক্তপিপাসু জাতিকে শান্তির ধর্মে দীক্ষিত করতে আদিষ্ট হলেন মানবতার বন্ধু শান্তির দূত মুহাম্মাদ সা:। রক্তের নেশার বদলে শান্তির পরশ বুলানো সহজ কাজ নয়। প্রেম-ভালোবাসা দিয়েই মানুষকে শান্তির পথে আহ্বান করেছেন মুহাম্মাদ সা:। অবিশ্বাসীদের ছোড়া পাথরের বিনিময় হেকমতি বাক্য ছুড়েছেন তিনি। শত্রুকে বন্ধু করেছেন। সন্ত্রাসীকে করেছেন জনগণের খাদেম। হজরত ওমর রা: ছিলেন মক্কার শ্রেষ্ঠ সন্ত্রাসী। আবু জাহেল, আবু লাহাবের মতো নেতারা পর্যন্ত তাকে হিসাব করে চলত। কুরআনের ছায়ায় আসামাত্রই সন্ত্রাসী ওমর হয়ে গেলেন শান্তির বাহক ওমর। এমনিভাবে শান্তির কারিগর মুহাম্মাদ সা: একদল শান্তিপ্রিয় সৈনিক তৈরি করে বিশ্ববাসীর সামনে বাস্তব দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন।
শান্তিপ্রিয় মুসলমান আজ বিশ্ববাসীর কাছে সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচয় পাচ্ছে। পশ্চিমারা নিজেদের স্বার্থে মুসলমানদের ব্যবহার করছে। ইসলামের শান্তি ও সুন্দরের আদর্শ মিডিয়ার প্রচারণায় ঢাকা পড়ছে বিশ্বের কাছে। মানবতার সমাধান পবিত্র কোরআনকে মানবতা বিধ্বংসী গ্রন্থ মনে করছে পশ্চিমারা।
বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের এই দুঃসময়ে উম্মতের আলেমদের নীরবতা মনে করিয়ে দিচ্ছে মহাপ্রলয় খুবই কাছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করা কুরআনের নির্দেশ। আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের বলেন, ‘তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি। তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের নির্দেশ দেবে, অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে’ (সূরা আলে ইমরান : ১১০)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘মুমিন বান্দাগণ পরস্পর বন্ধু। তারা সৎ কাজে আদেশ দেয়, অসৎ কাজের নিষেধ করে’ (সূরা তাওবাহ : ৭১)। পবিত্র কুরআন থেকে চোখ ফিরিয়ে মুসলিম বিশ্ব ও আলেমদের দিকে তাকালে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় আমরা কুরআনের অনুসারী! মানুষের মঙ্গলে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা- মুমিন চরিত্রের অপরিহার্য গুণাবলি। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা চাই, যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, সৎ কাজের আদেশ দেবে ও অসৎ কাজের নিষেধ করবে’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৪)।
রাসূল সা: বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ অসৎ কাজ এবং অপছন্দনীয় কিছু দেখবে, সে যেন তা হাত দিয়ে পরিবর্তন করে দেয়। হাত দিয়ে না পারলে মুখ দিয়ে পরিবর্তন করবে, মুখ দিয়ে না পারলে অন্তর দিয়ে পরিবর্তনের চিন্তা-চেতনায়, জল্পনা-কল্পনায় ব্যস্ত থাকবে। আর এটা হলো দুর্বল ইমানের লক্ষণ’ (মুসলিম)। রাসূল সা:-এর হাদিসটি পবিত্র কুরআনের এ আয়াতেরই ব্যাখ্যা- ‘ভালো আর মন্দ সমান নয়। মন্দকে ভালো দিয়ে পরিবর্তন করে দাও’ (সূরা হামীম-আস সাজদাহ : ৩৪)।
ইসলাম শান্তির ধর্ম। কুরআন শান্তির অমীয় বাণী। মুসলমানেরা শান্তির দূত। শান্তিপ্রিয় ধর্ম ও গ্রন্থ জাতিকে বিশ্ব দরবারে অশান্তির প্রতীক হিসেবে পরিচয় দেয়া কি অন্যায় নয়? মুসলমান দিয়ে মুসলমানকেই ঘায়েল করা কি অন্যায় নয়? যদি অন্যায় হয়ে থাকে তবে মুসলানদের কর্ণধার আলেমরা এর প্রতিবাদ করছে না কেন? ফ্রান্সে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে কোনো মুসলিম ব্যক্তি বা সংগঠন প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে বিশ্বকে মেসেজ দিচ্ছে না কেন- ‘এ গণহত্যার সঙ্গে ইসলাম ও মুসলমানরা জড়িত নয়। ধর্ম মানুষকে ভালোবাসার কথা বলে। নির্বিচারে মানুষ হত্যা ধর্ম সমর্থন করে না।’
হায় হতভাগা মুসলমান! জাতির কর্ণধার আলেমরা আজ ঘুমিয়ে পড়েছে। অন্যায়ের প্রতিবাদে হোসাইনি আদর্শে উজ্জীবিত হতে কাউকে আজ দেখা যাচ্ছে না। এর পরিণাম খুবই ভয়াবহ। জলিলুল কদর সাহাবি হজরত হুজায়ফা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেন, ‘যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ করে বলছি, অবশ্যই তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে, অসৎ কাজের নিষেধ করবে। যদি তা না করো, তবে আল্লাহর আজাব তোমাদের জন্য নির্ধারিত হয়ে যাবে। তখন তোমরা দোয়া করবে দোয়া কবুল হবে না’ (তিরমিজি)। দোয়া কবুল হবে না- মুসলমানদের জন্য এর চেয়ে বড় আজাব আর কী হতে পারে? মুসলমানেরা আজ অন্যায়ের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ না করে তাসবিহ দানা হাতে মসজিদের কোণে বসে রয়েছে। এ হাত তো তাসবিহ গোনার জন্য নয়। এ হাত প্রেম দিয়ে, সেবা দিয়ে অন্যায় জুলুম বদলে দেয়ার হাত। এ মুখ তো ‘বদলে যাও, বদলে দাও’ স্লোগান দেয়ার জন্য। এ অন্তর তো বদলানোর চিন্তায় বেকারার থাকার জন্য।
লেখক : বিশিষ্ট মুফাস্সিরে কুরআন