আজ ভয়াল ২৫ মার্চ
নিউজ ডেস্ক : স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের ওপর পরিচালিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মম গণহত্যার। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ বিষয়ে কাজ হলেও জাতিসংঘ ঘোষিত গণহত্যাবিষয়ক একটি দিবস থাকায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে এই স্বীকৃতি পাওয়া। তবে মুক্তিযুদ্ধবিয়ষক মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সময়সাপেক্ষ হলেও আন্তর্জাতিকভাবে এই স্বীকৃতি আদায়
করবে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে প্রায় ৫০ হাজার বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিল। গণহত্যা শুরুর পর থেকেই বীর বাঙালি প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলে। ওই রাতে একযোগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানায় তখনকার ইপিআর সদর দফতর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে হামলাসহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। নয় মাসে তারা ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করে। পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা শুরুর দিনটিকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনে গত বছর ১১ মার্চ সংসদে প্রস্তাব আনেন জাসদ নেত্রী শিরিন আখতার। সাত ঘণ্টা আলোচনার পর প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়। মন্ত্রিসভায় এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবও পাস হয়েছে। এবার দ্বিতীয়বারের মতো জাতীয় গণহত্যা দিবস পালন করবে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে চেষ্টা করা হচ্ছে দিবসটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘গণহত্যার সংজ্ঞা মেনে জাতিসংঘে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত ও দলিল পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোয় তথ্য-উপাত্ত পাঠানো হচ্ছে। এখন কূটনৈতিক পর্যায়েও প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছে। তখন যেসব রাষ্ট্র প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তারাও বুঝতে পেরেছে, একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল।’ মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যেই ১৫টি রাষ্ট্রের সম্মতি পেয়েছি। অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গেও কথা চলছে। স্বীকৃতি আদায়ের জন্য অন্তত ৮০টি রাষ্ট্রের সম্মতি প্রয়োজন। আমরা বিশ্বাস করি, কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সফলভাবে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিকে বোঝাতে সক্ষম হব। তাহলে ৯ ডিসেম্বরের পরিবর্তে ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের স্বীকৃতি পাওয়া আমাদের জন্য সহজ হবে।’
তবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতিসংঘ ঘোষিত গণহত্যাবিষয়ক একটি দিবস থাকায় এ স্বীকৃতি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যা দিবস পালনের পথ বন্ধ করেছে সরকারই। জানতে চাইলে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রধান শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘২০০৫ সাল থেকে নির্মূল কমিটি এ দিবসটি পালন করে আসছে। দীর্ঘকাল আমাদের দাবির প্রতি কোনো সরকারই কর্ণপাত করেনি।’ তিনি বলেন, ‘২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেতে আমরাও চেষ্টা করেছি, কিন্তু সরকারি উদ্যোগ না থাকায় তা সম্ভব হয়নি। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম। ইউনেস্কোকেও চিঠি দিয়েছিলাম। জবাব হিসেবে আর্মেনিয়া থেকে আমাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, বাংলাদেশে কি ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা হয়? আমরা জানিয়েছিলাম, হয় না। পরে জবাব এলো যে, যা বাংলাদেশ জাতীয়ভাবে পালন করে না, তা আন্তর্জাতিকভাবে কেন জাতিসংঘকে পালন করতে হবে? সে কারণে আর্মেনিয়ার প্রস্তাব অনুযায়ী, ৯ ডিসেম্বর গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ।’ তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ যেদিন ৯ ডিসেম্বরকে গণহত্যা দিবস ঘোষণা করে সেদিন বাংলাদেশও উপস্থিত ছিল। কিন্তু কোনো ভেটো দেয়নি, একবারও বলেনি, গণহত্যা দিবস হওয়া উচিত ২৫ মার্চ। কারণ বিশ্বের কোথাও এক দিনে এত বড় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়নি। অথচ তখন বাংলাদেশ কিছু বলেনি।’ একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে হত্যা ও নির্যাতন নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা করেছেন ওয়্যার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংয়ের আহ্বায়ক ডা. এম এ হাসান। গণহত্যার আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে যে হত্যা, নির্যাতন হয়েছে তা নিশ্চিতভাবেই জেনোসাইড বা গণহত্যা।’ তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে ২০০৪ সালে ইউনেস্কোর কাছে ২৫ মার্চকে গণহত্যা প্রতিরোধ দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। সে চিঠির জবাবেও বলা হয়েছিল জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র আবেদন করলে তা বিবেচনা করা যায়। ডা. হাসান জানান, পরে তৎকালীন সরকারও বিষয়টি নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। একই ধরনের একটি দিবস থাকায় ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া অনিশ্চিত বলে মনে করেন তিনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত হবে ২৫ মার্চ সামনে রেখে নয় মাসের ‘গণহত্যার স্বীকৃতি’ আদায় করে নেওয়া। সেই সঙ্গে ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক ‘গণহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করা। এ ব্যাপারে শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘আর্মেনিয়া, রুয়ান্ডা, কম্বোডিয়া, সিয়েরা লিওন ও বসনিয়ার মতো বাংলাদেশের গণহত্যাকে বিশ্ব সংস্থার স্বীকৃতি আদায় করতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতে হবে সরকারকে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস ও মিশনের মাধ্যমেও কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। তবে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব পালন করতে হবে সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করে বন্ধু দেশগুলোর স্বীকৃতি আদায়ের জন্য তাদের সংসদে এই প্রস্তাব পাস করার উদ্যোগ নিতে পরামর্শ দিয়েছি। আমরা বলছি আগে বেশির ভাগ দেশের কাছ থেকে আমরা স্বীকৃতিটা নিই। এরপর বন্ধুদের নিয়েই আমরা জাতিসংঘে যাব। তখন আমরা আশা করতে পারি, অদূর ভবিষ্যতে জাতিসংঘেরও স্বীকৃতি পাওয়া যাবে। কারণ, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ও জাতিসংঘের বিভিন্ন দলিলপত্রেও বলা হয়েছে স্মরণকালের ইতিহাসে নৃশংসতম গণহত্যার ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে।’ ডা. এম এ হাসান বলেন, ‘সময়োপযোগী পদক্ষেপের অভাবে ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এখন উচিত হবে ওই দাবি থেকে সরে এসে ২৫ মার্চকে “আন্তর্জাতিক গণহত্যা প্রতিরোধ দিবস” হিসেবে স্বীকৃতি জানানোর জন্য কাজ করা। এটাই আমাদের গণহত্যাকে সামনে আনবে।’ অবশ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিষ্ক্রিয়তা সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বলেন, ‘সরকার অনেক দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিজস্ব প্রক্রিয়ায় কাজ করছে।’
অন্ধকারে থাকবে এক মিনিট : কালরাতের প্রথম প্রহর স্মরণ করে গণহত্যা দিবসে আজ ২৫ মার্চ এক মিনিট অন্ধকারে (ব্ল্যাক-আউট) থাকবে সারা দেশ। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার স্মরণে রাত ৯টা থেকে ৯টা ১ মিনিট পর্যন্ত সব ধরনের বাতি বন্ধ রাখার কর্মসূচি নিয়েছে সরকার। গত ১১ মার্চ সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভা কক্ষে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। গণহত্যা দিবসে এক মিনিট বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখাসহ সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য এরই মধ্যে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে চিঠি পাঠিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। চিঠিতে জানানো হয়েছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জননিরাপত্তা বিভাগ, বিদ্যুৎ বিভাগ, তথ্য মন্ত্রণালয়, গণযোগাযোগ অধিদফতর এবং সব জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) মাধ্যমে গণহত্যা দিবসে এক মিনিট ব্ল্যাক আউট কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চ লাইট নামে নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালির ওপর আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। পরবর্তী নয় মাস চলা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তারা হত্যা করেছিল ৩০ লাখ মানুষকে। তাদের হাতে ধর্ষিত হয়েছিল সাড়ে তিন লাখেরও বেশি নারী। গণহত্যা শুরুর এই দিনটিতে শহীদদের স্মরণে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনে দীর্ঘদিন ধরে দাবি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের।
সারা বিশ্বে ৯ আগস্ট গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হলেও সেটি পাল্টে ২৫ মার্চ করতে চায় বাংলাদেশ। এ জন্য জাতিসংঘে দেন দরবার করছে বাংলাদেশ। তবে ২০১৭ সাল থেকেই ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে বাংলাদেশে। বিডি-প্রতিদিন