জীবনে বরকত ও উন্নতির উপায়
আল্লাহ পৃথিবীকে বান্দার বাসস্থান বানিয়েছেন৷ তাতে বরকত ও সমৃদ্ধি দান করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘তিনি ভূপৃষ্ঠে অটল পর্বতমালা স্থাপন করেছেন এবং তাতে বরকত বা কল্যাণ রেখেছেন৷’ (সূরা হা-মিম সাজদা, আয়াত : ১০)৷ আল্লাহ তাঁর নবীদের নির্বাচন করে তাদের জীবন ও কর্মে বরকত ও সমৃদ্ধি দানের মাধ্যমে অনুগ্রহ করেন৷ নূহ (আ.) সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘বলা হল, হে নূহ! আমার পক্ষ হতে শান্তি ও কল্যাণসহ অবতরণ কর৷’ (সূরা হুদ, আয়াত : ৪৮)৷ ঈসা (আ.) সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি যেখানেই থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন৷’ (সূরা মারইয়াম, আয়াত : ৩১)৷ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বকরত সুবিদিত ও প্রতিষ্ঠিত৷ সাহাবায়ে কেরাম তা স্বচক্ষে দেখেছেন৷ কুরআনের অনুসরণ ও তদনুযায়ী আমলের মধ্যে বরকত নিহিত আছে৷
আল্লাহ বলেন, ‘এই কিতাব যা আমি নাজিল করেছি তা বরকতময়৷ সুতরাং তোমরা তার অনুসরণ কর এবং সাবধান হও, তোমাদের প্রতি দয়া করা হবে৷’ (সূরা আনআম, আয়াত : ১৫৫)৷ বরকত অর্থ হলো সমৃদ্ধি ও উন্নতি৷ তা অল্প কিছুতে অন্তর্ভুক্ত হলে তাকে বৃদ্ধি করে দেয়৷ কোনো স্থানে তা অবস্থিত হলে সেখানে তার প্রভাব প্রকাশ পায়৷ তার কল্যাণধারা প্রবাহিত হয়৷ সম্পদ, সন্তান, সময়, জ্ঞান, কাজ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গে তার সুফল ও উপকারিতা ছড়িয়ে পড়ে৷
আল্লাহ তায়ালা কাবাঘর, পবিত্র মদিনা, মসজিদে আকসা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বরকত বরকত দান করেছেন৷ আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা তো মক্কায় অবস্থিত৷ তা বিশ্বজগতের জন্য বরকতময় ও পথের দিশারী৷’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ৯৬)৷ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি মক্কায় যে বরকত দান করেছেন তার দ্বিগুন মদিনায় দান করুন৷’ আল্লাহ এরশাদ করেন, ‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম হতে মসজিদে আকসা পর্যন্ত৷ যার পরিবেশ আমি বরকতময় করেছি, তাঁকে আমার নিদর্শন দেখাতে৷’ (সূরা ইসরা, আয়াত : ১)৷
আল্লাহ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের মাঝে বরকত দান করেছেন৷ ফলে তার উম্মত উন্নতি ও অগ্রগতি সাধন করে সব উম্মতকে ছাড়িয়ে গেছে৷ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘একটি বৃক্ষ আছে যার পাতা পড়ে না৷ সে গাছটি মুসলমানের ন্যায়, তোমরা আমাকে বল তো, সেটি কোন গাছ? তখন সবাই গ্রামাঞ্চলের বৃক্ষ নিয়ে ভাবতে লেগে গেল৷ তারপর তারা বলল, আপনিই বলে দিন তা কোন গাছ! তিনি বললেন, তা খেজুর বৃক্ষ৷’ মুসলমান যেখানেই যাবে সে বরকত অনুসন্ধান করবে৷ যাতে সে বরকত তার দেহ, জীবন, সন্তানাদি ও তার চারপাশের সব কিছুকে ঘিরে রাখে৷ ফসলের সময় হলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তা নিয়ে আসা হত৷ তখন তিনি বলতেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি আমাদের এ নগরীতে বরকত দান করুন, আমাদের এ ওজনের পাত্রে ও মুষ্ঠিতে বরকত দান করুন৷ আমাদের নগরীকে সমৃদ্ধি দিন৷ এক বরকতের সঙ্গে দুটি বরকত দান করুন৷’
সব সময় আল্লাহর জিকির করে এবং সূরা বাকারা তেলাওয়াত করে মুমিন ব্যক্তি তার গৃহে বরকত বয়ে আনবে৷ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘পুরুষ তার ঘরে প্রবেশ এবং খাবার খাওয়ার সময় আল্লাহর জিকির করলে শয়তান বলে, তোমাদের সঙ্গে না ঘুমে শরিক হতে পারব, না রাতের খাবারে৷’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা সূরা বাকারা পড়, কেননা তা গ্রহণ করলে বরকত হয়, বর্জন করলে অনুশোচনা করতে হয়৷ তবে ভ্রান্তরা তা করতে পারে না৷’ সব সময় ইস্তেগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করলে বরকত অবতীর্ণ হয়৷
নূহ (আ.) এর প্রার্থনা প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘বলেছি, তোমাদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর, তিনি তো ক্ষমাশীল৷ তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত করবেন, তিনি তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে সমৃদ্ধ করবেন এবং তোমাদের জন্য স্থাপন করবেন উদ্যান ও প্রবাহিত করবেন নদী-নালা৷’ (সূরা নূহ, আয়াত : ১০-১২)৷
মুমিন ব্যক্তি জামাতের সঙ্গে ফজরের নামাজের প্রতি যত্নশীল হয়ে বরকত তালাশ করবে৷ কেননা তাতে প্রভাতকালীন বরকত ও কল্যাণ লাভ করার বিরাট সফলতা নিহিত আছে৷ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘হে আল্লাহ, আমার উম্মতের জন্য প্রভাতকালীন বরকত অবতীর্ণ করুন৷’ কোনো সেনাদল বা বাহিনী প্রেরণ করলে রাসুলুল্লাহ তাদেরকে দিনের প্রথম প্রহরে পাঠাতেন৷ সাখার (রা.) ছিলেন একজন ব্যবসায়ী মানুষ৷ তিনি দিনের প্রথম ভাগে তাঁর বাণিজ্য কাফেলা পাঠাতেন৷ ফলে তিনি অনেক সম্পদ ও প্রাচুর্য অর্জন করেছিলেন৷
বরকত লাভের দোয়া করা বরকতের সৌভাগ্য অর্জনের শ্রেষ্ঠ উপায় এবং প্রচুর পরিমানে এ নেয়ামত পাওয়ার সেরা মাধ্যম৷ আকিল ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি এক নারীকে বিয়ে করেন৷ লোকেরা তাঁর গৃহে এসে বলল, ‘মিল-মহ্ববত হোক, সন্তানাদি হোক৷’ তখন তিনি বললেন, তোমরা এরকম করে বলো না৷ তারা বলল, হে আবু জায়েদ, তবে আমরা কী বলব? তিনি বললেন, তোমরা বল, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য বরকত দান করুন৷ তোমাদের ওপর বরকত নাজিল করুন৷’ আমাদেরকে এরকমই নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷’
ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য সালামের প্রসার ঘটালে বরকত সাধিত হয়৷ এটা এ উম্মতের বরকতময় বিশেষত্ব৷ আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা বাড়িঘরে প্রবেশের সময় নিজেদেরকে সালাম দিবে৷ আল্লাহর পক্ষ হতে বরকতময় পবিত্র সালাম৷’ (সূরা নূর, আয়াত : ৬১)৷ ব্যবসায় সততা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখলে তাতে বরকত আসে৷ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘ক্রেতা-বিক্রেতা আলাদা না হওয়া পর্যন্ত অধিকার বহাল থাকবে৷ তারা সততা ও স্বচ্ছতা অবলম্বন করলে তাদের ব্যবসায় বরকত হবে৷ মিথ্যাচার ও অস্বচ্ছতা করলে তাদের ব্যবসার বরকত নষ্ট হয়ে যাবে৷’
আত্মীয়তা বজায় রাখা বরকতের বড় উৎস৷ তা দীর্ঘায়ু দান করে৷ জীবিকা সমৃদ্ধ করে৷ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার জীবিকার সমৃদ্ধি কিংবা জীবনের আয়ু বাড়িয়ে প্রশান্তি লাভ করতে চায় সে যেন তার আত্মীয়তা বজায় রাখে৷’ পরস্পর সম্প্রীতি ও একতা বরকত বয়ে আনার উপায়৷ নবীজী সাহাবায়ে কেরামকে সর্বাবস্থায় ঐক্যবদ্ধ থাকতে এবং বিভক্ত না হতে উদ্বুদ্ধ করতেন৷ দুঃস্থ, দুর্বল ও অসহায় লোকদের সহযোগিতা ও দয়া করলে, মুসলিম সমাজে যে বরকত বৃদ্ধি কামনা করে তার জন্য সেটি একটি প্রশস্ত ক্ষেত্র৷ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘অসহায় ও দুর্বল লোকদের বদৌলতেই তোমাদেরকে জীবিকা ও বিজয় দান করা হয়৷’
মুসলিম জীবনে বরকত অর্জন হলে আল্লাহ তাকে শরিয়ত সম্পর্কে পরিপক্ক সুস্থ বুদ্ধি দান করেন, ঈমান ও ইলম দিয়ে তার হৃদয় উজ্জীবিত করেন৷ অল্প সময়ে সে সুখ-সমৃদ্ধি ও কল্যাণ অর্জন করে সঙ্গীদের ছাড়িয়ে যায়৷ বরকতের প্রভাবে সৎকর্ম, উত্তম কথা, দীর্ঘ আয়ু, নেককার স্ত্রী ও সন্তান লাভ হয়৷ আল্লাহ আমাদের সবাইকে বরকত দান করুন৷ আমীন।
২ জমাদিউল আওয়াল ১৪৩৯ হিজরি মসজিদে নববির জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর করেছেন
মাহমুদুল হাসান জুনাইদ