আশুগঞ্জে বন্ধ হচ্ছে শতাধিক চাতালকল
---
দেশের পূর্বাঞ্চল ও হাওরাঞ্চলের সর্ববৃহৎ পাইকারি মোকাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে দিন দিন কমছে ধানের আমদানি। বিগত বছরগুলোর তুলনায় এই মোকামে ধানের আমদানী এখন এক তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে।
হাওরে ধান নেই, তাই ধানের আমদানিও নেই আশুগঞ্জ মোকামে। আর আমদানি কমে যাওয়ায় এবার ধানের দামও যেন আকাশছোঁয়া। বৃহৎ এই মোকামে এবারই সর্বোচ্চ দামে ধান বিক্রি হচ্ছে। ধানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চালের দামও।
এদিকে ধান সংকটের কারণে ইতোমধ্যে বন্ধ হতে চলেছে শতাধিক চাতালকল। যাদের কাছে আগে থেকেই ধান মজুদ রয়েছে তাদের অধিকাংশ মিলই এখন সচল রয়েছে। এভাবে চলতে থাকালে আগামী এক মাসের মধ্যে ধান সংকটের কারণে চাতালকলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ধান-চাল ব্যবসায়ীরা।
এছাড়া ধান ও চালের আমদানি কম থাকায় অলস সময় কাটাচ্ছেন এখানকার শ্রমিকরা।
বুধবার সরেজমিনে আশুগঞ্জ মোকামে গিয়ে জানা যায়, দেশের পূর্বাঞ্চলের ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার হাওরাঞ্চলের উৎপাদিত ধান আশুগঞ্জ মোকামে বেচাকেনা হয়ে থাকে। আর হাওর অঞ্চলের উৎপাদিত ধান দিয়েই চলে আশুগঞ্জ উপজেলা অর্ধ সহস্রাধিক চাতালকল।
অন্যান্য বছরে আশ্বিন মাসে প্রতিদিন ৮০ থেকে ৯০টি নৌকা দিয়ে গড়ে ৬০ থেকে ৭০ হাজার মণ ধান বাজারে বেচাকেনা হতো। কিন্তু বর্তমানে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫টি নৌকা দিয়ে গড়ে ১৫ থেকে ২০হাজার মণ ধান আসছে এ মোকামে। যা গত বছরের তুলনায় এক তৃতাংশেরও কম। ফলে দেশের পূর্বাঞ্চলীয় সবচেয়ে বড় পাইকারি মোকাম আশুগঞ্জে বেড়েছে ধান ও চালের দাম।
আশুগঞ্জ মোকামের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ধানের আমদানি কম হওয়াতে ধান সংকটে মিল চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই অনেক মিল বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে ব্যবসায়ীরা। আবার অনেকে মিল চালু রাখতে আগে থেকেই কিছু ধান মজুদ করে রাখতে হয়েছে। এতে করে ধার দেনা করে বিপুল পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয়েছে। তাই মিল মালিকরা বর্তমান দামে ধান কিনে চালের বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য না থাকার কারণে বেশি দামে চাল বিক্রি করেও লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে।
তাদের ব্যবসায়ীক জীবনে ধানের এত দাম কখনো দেখেননি। বর্তমানে এক মণ আটাশ ধান ১৩৪০ থেকে ১৩৬০ টাকা, বিআর-২৯ ধান ১২৫০ থেকে ১২৮০ টাকা, মোটা ধান ৯৫০ থেকে ১০০০টাকা দরে কেনা-বেচা হচ্ছে।
গত ৮ বছরে ধানের দাম সরকারি ও বেসরকারিভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০১০ সালে ধান ক্রয়ের জন্য সরকার মূল্য নির্ধারণ করেছিল প্রতি কেজি ১৭ টাকা। সে হিসাবে এক মণ ধানের দাম ছিল ৬৮০ টাকা। ২০১১ সালে সরকারের ধান কেনার কোনো রেকর্ড নেই। তবে চাল কেনা হয় প্রতি কেজি ২৯ টাকায়। বেসরকারি পর্যায়ে ওই বছর ধানের দাম ছিল প্রতি মণ ৭০০-৭২০ টাকা। ২০১২ সালে সরকারি রেট অনুযায়ী প্রতি মণ ধানের দাম ৭২০ টাকা, ২০১৩ সালে ৭২০ টাকা, ২০১৪ সালে ৮০০ টাকা, ২০১৫ সালে ৮৮০ টাকা, ২০১৬ সালে ৯২০ টাকা এবং ২০১৭ সালে সরকার ধানের দাম নির্ধারণ করেছে ৯৬০ টাকা। কিন্তু সেই ধান এখন বিক্রি হচ্ছে ১৩০০-১৪০০ টাকা মণ।
এদিকে, আশুগঞ্জ মোকামের শ্রমিক আবু তাহের বলেন, “আাগের মত এখন আর কাজ নাই। আগে প্রতিদিন ৮০ থেকে ৯০ টা নৌকা ধান নিয়ে আসত এই মোকামে। তখন কাজও ছিল বেশি। এখন নৌকা আসে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ২০ থেকে ৩০ টা। ফলে আমাদের অলস সময় কাটাতে হচ্ছে।”
এব্যাপারে আশুগঞ্জ উপজেলা চাতালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ধান-চাল ব্যবসায়ী হাজী মো. শাহজাহান সিরাজ জানান, ৩০ বছর ধরে ব্যবসা করছেন তিনি। ধান কিনে তা চাতালকলে সিদ্ধ করে শুকিয়ে চাল তৈরি করে বাজারে বিক্রি করেন।
ধানের দাম নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “চাতালকল মালিকদের জন্য এটা দুর্যোগের বছর। ধান ও চালের এত দাম জীবনে প্রথম দেখলাম। এবারই প্রথম এক মণ আটাশ ধান এক হাজার ৪০০ টাকায় পর্যন্ত কিনেছি। ধান সংকটের ফলে কলগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আগামী বোরো ধান না ওঠা পর্যন্ত এসব চাতালকল সচল করা সম্ভব হবে না। তাই এবছর ব্যবসায়িদের ব্যাপক লোকসান গুনতে হবে।”
আশুগঞ্জের ধান-চাল ব্যবসায়ী মো. কামরুজ্জামান রিপন জানান, আটাশ ধান এবার প্রতি মণ ১ হাজার ৪০০ টাকা এবং বিআর-২৯ ধান প্রতি মণ ১ হাজার ৩৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। একই ধান এক বছর আগে কেনা হয় ৮০০-৯০০ টাকায়।
তিনি আরও জানান, ধানের দাম বেশি হলে স্বাভাবিকভাবে চালের দামও বেশি হয়। বর্তমানে চাল বিআর-২৯ প্রতি ৫০ কেজির বস্তা ২ হাজার ২৫০ থেকে ২ হাজার ২৭০ টাকা। আর মোটা চাল ১ হাজার ৮০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৮৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
এব্যাপারে জেলা চাতালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ওবায়দুল্লাহ জানান, হাওরাঞ্চলের বৃহৎ এই মোকামে ধানের সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। ধানের অভাবে ইতোমধ্যে প্রায় শতাধিক চাতালকল বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। আগামী ১৫ দিন পর বাজারে আর ধান পাওয়া যাবে না। সুতরাং ধান সংকটের কারণে আগামী এক মাসের মধ্যে জেলার অর্ধ সহস্রাধিক চাতালকলের মধ্যে অধিকাংশই বন্ধ হয়ে যাবে।
তিনি আরও জানান, মিল কিছু চালু রাখতে হলে উত্তরাঞ্চলের ধানের ওপর নির্ভর করতে হবে।
এব্যাপারে সরকারের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি জানান তিনি।