ইতিহাসের পাতায় শোলাকিয়া
---
নিজস্ব প্রতিবেদক : শোলাকিয়া শুধু ঈদগাহ ময়দানই নয়, এর ঝুলিতে আছে বিভিন্ন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দাগ। ১৮২৮ সাল থেকে নিয়মিত ঈদের বড় জামাত অনুষ্ঠিত হলেও শোলাকিয়া মাঠে প্রথম ঈদের নামাজ হয় ১৭৫০ সালে। মসনদ-ই-আলা ঈশা খাঁর বংশধর দেওয়ান মান্নান দা খাঁ-এর ওয়াকফ নামায় ১৭৫০ সাল থেকে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বলে লেখা রয়েছে।
তথ্যানুযায়ী, মাঠের বর্তমান বয়স ২৬৭ বছর। জঙ্গলবাড়ির জমিদার ১৮২৮ সাল থেকে নিয়মিত এখানে ঈদের নামাজ আদায় করতেন। ১৮২৮ সালের প্রথম বড় জামাতে হয়বতনগর সাহেব বাড়ির ঊর্ধ্বতন পুরুষ শাহ সূফি সৈয়দ আহমদ (রঃ) ইমামতি করেন। অনেকের মতে, মোনাজাতে তিনি মুসল্লিদের প্রাচুর্য প্রকাশে ‘সোয়া লাখ’ কথাটি ব্যবহার করেন।
অন্য এক মতে, সেদিনের জামাতে ১ লাখ ২৫ হাজার (অর্থাৎ সোয়া লাখ) লোক জমায়েত হয়েছিলেন। ফলে সোয়া লাখ থেকে এক সময় পরিবর্তিত হয়ে শোলাকিয়া নামটি চালু হয়ে যায়। আবার কারও কারও মতে, মোগল আমলে এখানে অবস্থিত পরগনার রাজস্বের পরিমাণ ছিল সোয়া লাখ টাকা। উচ্চারণের বিবর্তনে সোয়া লাখ থেকে ‘সোয়ালাখিয়া’ সেখান থেকে ‘শোলাকিয়া’ হয়েছে।
শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শাহ সূফি সৈয়দ আহমদের (র.) পূর্বপূরুষরা সুদূর মক্কা শরীফ থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন করে বর্তমান ভারতের বর্ধমান জেলার টেঙ্গাপাড়ায় বসবাস শুরু করেন। সৈয়দ আহমদের (র.) পিতা সৈয়দ ইব্রাহীম (র.) উত্তর কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম শিক্ষা প্রচার-প্রসার ও দাওয়াতের কাজ করতে গিয়ে কিশোরগঞ্জ শহর থেকে সাত মাইল দূরবর্তী কান্দাইল গ্রামে আসেন। পরবর্তীতে সেখানে স্থানীয় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। পরবর্তীতে তিনি সাংসারিক জীবনকে বন্দি জীবন মনে করে ইসলাম প্রচারে বেরিয়ে পড়েন। বের হওয়ার পর তিনি আর ফিরে আসেননি। তবে অনেকের মতে, তিনি পবিত্র মক্কা শরীফে চলে যান এবং সেখানেই ইন্তেকাল করেন।
এদিকে মরহুম সৈয়দ ইব্রাহীমের (র.) বাড়িতে রেখে যাওয়া গর্ভবতী স্ত্রীর এক পুত্রসন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। স্বামীর পূর্ব নির্দেশ মোতাবেক পুত্রের নাম ও পরবর্তী সময়ে ১২ বছর বয়সে শিক্ষা-দীক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ঢাকার আজিমপুর দায়রা শরীফে প্রেরণ করা হয়। বালক পুত্র সৈয়দ আহমদ সেখানে ২৪ বছর অবস্থান করে শিক্ষা-দীক্ষায় পরিপক্ক জ্ঞান লাভের পর পীরের নির্দেশে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় চলে আসেন এবং তিনি শহীদ ময়েজ উদ্দিন মজনুর (র.) মাজারের পাশে একটি দ্বীন শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে তোলেন।
পরবর্তীতে তার দ্বীন শিক্ষার গল্প চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে দলে দলে লোকজন তার কাছে এসে দ্বীনি শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকেন। এ সময় ঈশা খাঁর বংশধররা জঙ্গলবাড়ি ও হয়বতনগর এলাকার জমিদারদ্বয় সৈয়দ আহমদকে (র.) তাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে বসবাসের সুযোগ করে দেন এবং তার সমস্ত দ্বীনি দাওয়াতের কাজে সহযোগিতা করেন।
এ সময় এই এলাকায় কোনো মসজিদ না থাকায় ১৮২৭ সালে সৈয়দ আহমদ (র.) বাড়ি সংলগ্ন জায়গায় একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদ প্রতিষ্ঠার পরপরই তিনি ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য ঈদগাহ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তিনি তার ক্রয় করা তালুক সম্পত্তিতে ঈদগাহ মাঠ প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং এ ব্যাপারে জঙ্গলবাড়ি ও হয়বতনগরের জমিদারকে সহায়তা করার অনুরোধ জানিয়ে আসন্ন ঈদুল ফিতরের প্রথম জামাতে শরীক হওয়ার দাওয়াত দেন।
জমিদার সেই দাওয়াত কবুল করেন এবং এ অঞ্চলের আপামর জনসাধারণের অংশগ্রহণে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে ১৮২৮ সালের ঈদুল ফিতরের ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়।
শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের আকর্ষণীয় ও বিশাল জামাত একইসাথে গৌরবান্বিত করেছে কিশোরগঞ্জকে। যদিও মুসল্লিদের স্থান সংকুলান, অবকাঠামো উন্নয়নসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার উন্নত ব্যবস্থা এখনও গড়ে ওঠেনি। তবুও প্রতিটি জামাতেই মুসল্লির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। ফলে মাঠে স্থান সংকুলান না হওয়ায় বিপুলসংখ্যক মুসল্লি নামাজ না পড়েই বাধ্য হয়ে ফেরত যান। জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে ঈদগাহ পরিচালনা কমিটি থাকলেও এর কার্যক্রম কেবল ঈদ কেন্দ্রিক হওয়ায় সারাবছর রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে তেমন কোনো তত্পরতা লক্ষ্য করা যায় না।