দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন: চুক্তি কাল
---
নিজস্ব প্রতিবেদক : বন্দরনগরী চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে সৈকতনগরী কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের লক্ষ্যে আগামীকাল বুধবার বাংলাদেশ সরকার ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মধ্যে চুক্তি হচ্ছে। আর এই চুক্তির আলোকে আগামী আগস্ট মাসেই বহুল প্রত্যাশিত এই রেললাইন নির্মাণ কাজ শুরু করা যাবে। তবে এই ধাপে রেললাইনটি ঘুনদুম পযন্ত সম্প্রসারিত হবে না।
দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন জানান, এডিবির সম্মতি পাওয়া মাত্রই রেললাইনের কাজ শুরু হবে। আশা করা হচ্ছে, আগামী আগস্ট মাস থেকে এই প্রকল্পের কাজ দৃশ্যমান হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আশা করা হচ্ছে, রেললাইনটি নির্মাণ হলে ঢাকা থেকে কক্সবাজারে পৌঁছতে সময় লাগবে মাত্র ৬ ঘণ্টা। যেখানে বর্তমানে গাড়িতে যেতে লাগে ১২ ঘণ্টা বা তারও বেশি। এমনকি কলকাতা থেকে কেউ কক্সবাজার আসতে চাইলে তার সময় লাগবে ১৮ ঘণ্টার মতো।
জানা গেছে, অবশেষে ৩০ কোটি ডলার বা দুই হাজার ৪শ’ কোটি টাকার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। বুধবার এ নিয়ে এডিবি ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি হবে বলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সূত্রে জানানো হয়েছে। ইআরডির ভারপ্রাপ্ত সচিব কাজী শফিকুল আযম ও এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর কাজুহিকো হিগুচি নিজ নিজ পক্ষে এই চুক্তিতে সই করার কথা রয়েছে। সাউথ এশিয়া সাব রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক) প্রকল্পের আওতায় এই ঋণ দেয়া হচ্ছে। এর ফলে রেললাইন প্রকল্পটি নিয়ে আবারো আশার সঞ্চার হয়েছে।
উল্লেখ্য, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন তৈরির মাধ্যমে ২০১৩ সালে যাত্রী পরিবহণ শুরুর ঘোষণা দিয়ে কক্সবাজার শহরে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল। সেই ভিত্তিপ্রস্তরটি জরাজীর্ণ হতে চললেও কাজ শুরু হয়নি। এরপরও রেললাইনের স্বপ্ন দেখে যাচ্ছে কক্সবাজারবাসী। চলতি বছরের আগস্টে লাইনটির কাজ শুরু করার কথা রয়েছে, যা শেষ হবে ২০২২ সালে।
জানা যায়, দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ঘুমধুম পর্যন্ত মিটারগেজ রেললাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয় ২০১০ সালে। ওই বছর জুলাই মাসে প্রকল্পটি (ডিপিপি) অনুমোদন পায়। সে সময় এর ব্যয় ধরা হয় ১৮৫২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এরপর ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজার শহরতলীর বাস টার্মিনালের কাছে ‘দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার’ এবং ‘রামু-ঘুমধুম মিটারগেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
কিন্তু অর্থ সংস্থানের অভাবে প্রকল্পটি এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়। গত ৭ বছরেও জমি অধিগ্রহণ কাজ সম্পন্ন করা যায়নি। যদিও সরকারি তরফ থেকে বারবার প্রতিশ্রুতি আসছিল। এমনকি ২০১৪ সালে নতুনভাবে ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী তাঁর কক্সবাজার সফরে প্রকল্পটি খুব শীঘ্রই বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এরপর তিন বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পটির কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। তবে এডিবির ঋণের প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০২২ সালে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ চালুর লক্ষ্যে প্রকল্পটি নিয়ে আবারো নড়াচড়া শুরু হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, ‘জমি অধিগ্রহণের জন্য মামলা চূড়ান্ত রয়েছে। কিন্তু অর্থ বরাদ্দের অভাবে অধিগ্রহণ কাজ আটকে রয়েছে।’ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম ধাপে রেললাইন আসবে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত। রামু থেকে ঘুনধুম পর্যন্ত রেললাইনটি আপাতত হচ্ছে না। ভবিষ্যতে সেটি করা হবে দ্বিতীয় ধাপে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) গত বছর এ প্রকল্পের কাজে সহযোগিতার আগ্রহ প্রকাশ করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১৯ এপ্রিল এ প্রকল্পের সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদন দেয় সরকার। সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী রেললাইনটি সিঙ্গেল লাইন বা মিটারগেজের পরিবর্তে ব্রডগেজে নির্মাণ করা হবে।
রেলওয়ে সূত্র মতে, প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১শ’ দশমিক ৮ কিলোমিটার মূল রেললাইন এবং ৩৯ দশমিক ২ কিলোমিটার লুপ লাইনসহ ১৪০ কিলোমিটার নতুন সিঙ্গেল লাইন (ডুয়েলগেজ ট্র্যাক রেলপথ) নির্মাণ করা হবে। এ লাইনে থাকবে ৩৯টি বড় ব্রীজ এবং ১৪৫টি ছোট ব্রীজ ও কালভার্ট। হাতি চলাচলের ছয়টি সুনির্দিষ্ট পথে নির্মাণ করা হবে বিশেষ ওভার ব্রীজ।
এই রেলপথ আসবে চন্দনাইশের দোহাজারী থেকে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, কক্সবাজারের চকরিয়া, রামু ও সদর উপজেলার উপর দিয়ে কক্সবাজার শহর পর্যন্ত। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মাণ করা হবে ৯টি স্টেশন। স্টেশনগুলো হবে দোহাজারী, লোহাগাড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজারে। রামুতে হবে জংশন। কক্সবাজারের রেলস্টেশনটি নির্মাণ করা হবে সামুদ্রিক ঝিনুকের আদলে।
রেলসূত্র আরো জানায়, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথটি নির্মাণ হবে দুই ভাগে। প্রথম ভাগে নির্মাণ করা হবে দোহাজারী থেকে চকরিয়া পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার ট্র্যাক। একই সাথে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত সিগনালিং ও টেলিকমিউনিকেশনের কাজ সম্পন্ন করা হবে। এর জন্য সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৬৪১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। আর দ্বিতীয় ধাপে চকরিয়া থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার ট্র্যাক এবং কক্সবাজারে আইকনিক ইন্টারমডেলের টার্মিনাল বিল্ডিংয়ের নির্মাণ কাজ শুরু হবে। এ ভাগের কাজের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৫৯১ কোটি ২০ লাখ টাকা। ইতোমধ্যে এ প্রকল্পের দাখিলকৃত দরপত্র মূল্যায়ন শেষ করে মতামতের জন্য গত ১৭ মার্চ এডিবির কাছে পাঠানো হয়। তাদের সম্মতি পাওয়ার পর সরকার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করে কার্যাদেশ প্রদান করবে।