রাজশাহীতে এবারও চাহিদার শীর্ষে সিল্কের পোশাক
---
নিজস্ব প্রতিবেদক : নিচতলার কারখানায় দম ফেলার সময় নেই শ্রমিকদের। সিল্কের সুতো দিয়ে চলছে কাপড় তৈরির কাজ। উচ্চশব্দের এ কারখানার ওপরেই নিরিবিলি পরিবেশে সুন্দর শো-রুম। সেখানে বিক্রি হচ্ছে সিল্কের নানা পোশাক। ক্রেতায় ক্রেতায় ঠাসা রেশম নগরী রাজশাহীর বিসিক শিল্প এলাকার সপুরা সিল্কের এই শো-রুমটি।
বুধবার সকালে সপুরা সিল্কে গিয়ে এমন দৃশ্যই দেখা গেল। এবার ঈদে মানুষের চাহিদা পূরণে এভাবেই সিল্কের পোশাকের পসরা সাজিয়েছে শো-রুমগুলো। রাতদিন কাজ করে সিল্কপল্লীর কারিগররা নিপুন হাতে শাড়ি, থ্রি-পিস, পাঞ্জাবিসহ নানা ধরনের পোশাক তৈরি করে তুলছেন শো-রুমে।
সপুরা সিল্কের বিপণন ব্যবস্থাপক সাইদুর রহমান জানালেন, এবারও ঈদে ক্রেতাদের চাহিদার শীর্ষে রয়েছে সিল্কের পোশাক। তাই কারখানায় এখন কাজ চলছে পুরোদমে। প্রথম রোজার দিন থেকেই জমে উঠেছে তাদের ঈদের বাজার। শুধু রাজশাহীই নয়, জেলার বাইরে থেকেও আসছেন ক্রেতারা। ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের পাইকারী ক্রেতারাও কিনে নিয়ে যাচ্ছেন ঈদের নতুন সিল্ক পোশাক।
সাইদুর রহমান জানান, এবার ঈদ উপলক্ষে তারা বেশকিছু নতুন ডিজাইনের পোশাক তৈরি করেছেন। এর মধ্যে বলাকা সিল্কের থ্রি-পিস পাওয়া যাচ্ছে আড়াই হাজার থেকে সাড়ে ৮ হাজার টাকায়। মসলিনের থ্রি-পিসের দাম সাড়ে চার হাজার থেকে সাত হাজার ৮০০ টাকা। সিল্কের শার্ট বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৩০০ থেতে এক হাজার ৬০০ টাকায়। আর পাঞ্জাবির দাম তিন থেকে ছয় হাজার টাকা।
এছাড়া মসলিন সিল্কের ওপর হাতের কারুকাজ করা শাড়ি বিক্রি হচ্ছে ছয় হাজার থেকে দশ হাজার টাকায়। বলাকার শাড়ি সাত হাজার ৮০০ থেকে সাড়ে ১৪ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এসব নতুন পোশাকের পাশাপাশি এমব্রয়ডারি, মসলিন শিপন, জামদানি, ধুপিয়ান, র-কাতান, জয়শ্রী, স্বর্ণ কাতান, মসলিন ব্রাশো, ঝলক কাতানসহ বাহারি রং আর মনকাড়া ডিজাইনের সিল্ক কাপড়ে ঠাসা রয়েছে তাদের শো-রুম।
সিল্কের থ্রি-পিস, হিজাব, ওড়না, স্কার্ফ এবং মসলিন, মটকা, তসর কাতান, বলাকা কাতান, সাটিং সিল্ক ও এনডি প্রিন্টের শাড়ি থরে থরে সাজানো রয়েছে রাজশাহী সিল্ক ফ্যাশনের শো-রুমে। এখানে রয়েছে বাচ্চাদের সিল্কের বাহুবালি-২ এবং বড়দের শার্ট, পাঞ্জাবি ও ফতুয়াসহ সিল্কের নানা পোশাক। শার্ট এক হাজার থেকে আড়াই হাজার, পাঞ্জাবি এক থেকে পাঁচ হাজার এবং স্কার্ফ, ওড়না ও হিজাব বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে এক হাজার ১০০ টাকায়।
এখানকার বিপণন ব্যবস্থাপক খুরশিদা খুশি বলেন, ঐতিহ্যবাহী সিল্ক কাপড় কিনতে প্রতিদিনই ভিড় বাড়ছে ক্রেতাদের। এবারও রোজার শুরু থেকেই ক্রেতা সমাগম রয়েছে তাদের শো-রুমে। দামও খুব সাশ্রয়ী। তার ওপর দেওয়া হচ্ছে ১৫ শতাংশ ছাড়। এবার সিল্কের পোশাক বিক্রি হচ্ছে গতবারের চেয়েও বেশি। রেডিমেড পোশাকের পাশাপাশি অনেকেই সিল্কের থান কাপড় গজ হিসেবে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, সপুরার পুরো সিল্কপল্লীর ঐতিহ্যবাহী কাপড়ের কদর রয়েছে সারা বছরই। বাঙালির বিভিন্ন উৎসবে সেই কদর আরো কয়েক গুণ বেড়ে যায়। হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সব শ্রেণির মানুষের উৎসবেই এক অন্যরকম আমেজ আনে রাজশাহীর সিল্কের পোশাক। ফলে এবার ঈদকে ঘিরেও সিল্কের বাজার জমে উঠেছে।
নগরীর আমেনা সিল্কের শো-রুমে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন ক্রেতা নিজেদের পছন্দের কাপড় কেনার জন্য একটার পর একটা কাপড় দেখছেন। কথা হয় পাবনা থেকে আসা নূরজাহান বেগম নামে এক নারীর সঙ্গে। তিনি জানান, প্রতি ঈদের আগেই তিনি রাজশাহীতে বেড়াতে এসে সিল্ক কাপড় কিনে নিয়ে যান। তাই এবারও এসেছেন। নিজের ও শাশুড়ির জন্য একটা করে শাড়ি এবং স্বামীর জন্য একটা পাঞ্জাবিসহ আরো কিছু কেনেন তিনি। তার কাছে দামও মনে হয়েছে সহনশীল।
এখানকার বিপণন ব্যবস্থাপক সেলিম হোসেন জানান, গত বছরের তুলনায় এবার রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী সিল্ক কাপড়ের দাম তেমন বাড়েনি। গত বছর সিল্কের যে শাড়ির দাম ছিল তিন হাজার টাকা, এবার তা বেড়ে হয়েছে তিন হাজার ৩০০ টাকা। কিন্তু বাজারে অন্যান্য শাড়ির দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এই শো-রুমে মেয়েদের ওয়ান পিস ও কটন সিল্কের ফতুয়া বিক্রি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
উষা সিল্কের শো-রুমে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে সিল্কের পাঞ্জাবিতেও এবার এসেছে নতুনত্ব। এনডি ও বলাকা সিল্ক কাপড়ের ওপরে কাজ করা পাঞ্জাবি বিক্রি হচ্ছে বেশি। মেয়েদের থ্রি-পিসেও এসেছে বাহারি রঙ ও ডিজাইন। এখানকার পাঞ্জাবি ক্রেতা জুলহাস শেখ বলেন, ‘দেশের ঐতিহ্যবাহী এই কাপড় শুধু ঈদে নয়, সারা বছরই মানুষের মন কাড়ে। তবে উৎসবে এর কোনো জুড়ি নেই।’
বিসিকের সিল্কপল্লীতে গিয়ে দেখা গেছে, কারিগররা সবাই ব্যস্ত কাজে। নারী কর্মীদের মধ্যে কেউ সুঁই সুতোর ফোঁড়নে কাপড়ে আঁকছেন বাহারি নকশা। কেউ করছেন রঙের কাজ। আবার কেউ কাপড়ে চুমকি ও পুঁথি বসানোর কাজও করছেন। কেউ চালাচ্ছেন তাঁত। এবার ঈদে সিল্কপল্লীতে ৪০ থেকে ৪৫ কোটি টাকার বাণিজ্যের আশা করছেন কারখানা মালিকেরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এক সময় রাজশাহীতে ৭৬টি সিল্ক কারখানা ছিল। এখন বন্ধ হয়ে নেমেছে মাত্র ৬টিতে। স্থানীয়ভাবে ৪০ শতাংশ সুতার চাহিদা মেটে ব্যবসায়ীদের। বাকি ৬০ ভাগ সুতা আমদানি করতে হয় ভারত ও চীন থেকে। এমন প্রতিকূলতার মাঝে রেশম নগরীর নাম টিকিয়ে রেখেছেন ওই ৬টি কারখানা। আর কারখানাগুলোতেই গড়ে উঠেছে ১৩টি শো-রুম। কারখানা ও শো-রুমগুলোতে এখনও পুরুষের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক নারী শ্রমিক কাজ করছেন।
বাংলাদেশ রেশম শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি লিয়াকত আলী বলেন, যেসব কারখানা চালু রয়েছে, সীমাবদ্ধতার মাঝেও তারা ক্রেতার মন জয় করতে চেষ্টা করছেন। তাই রাজশাহীর সিল্কের ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারের বিশেষ সহায়তা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
রাজশাহী সিল্ক ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী আবদুল কাদের মোল্লা বলেন, ভারত ও চীন থেকে সিল্কের কাপড় আমদানির কারণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এছাড়া এখন অনলাইনে নকল সিল্কের কাপড়ের ছড়াছড়ি। দেশের একটি প্রতারকচক্র রাজশাহীর সিল্ক নামে অনলাইনে নকল সিল্কের কাপড় বিক্রি করছেন। এতে ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছেন। রাজশাহীর সিল্কেরও সুনাম ক্ষুণ হচ্ছে। এটি বন্ধে প্রশাসনের কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।