শনিবার, ১৮ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ইং ৬ই ফাল্গুন, ১৪২৩ বঙ্গাব্দ

৪১ বিড়ালের ‘মা’ আলেপা খাতুন!

AmaderBrahmanbaria.COM
ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৭

পাবনার চাটমোহর পৌরসভার ৪, ৫ ও ৬ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী আসনের পরপর দু-বারের নির্বাচিত কাউন্সিলর আলেপা খাতুন (৪২)।

এলোমেলো চুল, পোশাক পরিধানে অতিসাধারণ। বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া দুই শতক জায়গার ওপর দু’টো কুঁড়ে ঘর করে ছেলেকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন। ভোর থেকেই শুরু হয় তার কর্মব্যস্ততা। তবে এ কর্মব্যস্ততা একটু অন্যরকম! কারণ তিনি যে ৪১টি বিড়ালের ‘মা’! কথাটা শুনতে একটু অন্যরকম মনে হলেও এটাই সত্যি।

বর্তমান সমাজে মানুষের মধ্যে যেখানে নিজে ভালো থাকার প্রবণতা বেশি, সেখানে আলেপার পশু প্রেম দেখলে যে কেউ হতবাক হবেন। কাউন্সিলর হলে কি হবে। সাংসারিক অবস্থা ভালো না। কোনো মতে চলে সংসার। সেখানে তিনি তার সম্মানীর সব টাকা খরচ করে ৪১টি বিড়ালের অন্ন জুগিয়ে চলেছেন। তবে শুধু সম্মানীর টাকা দিয়েই বিড়ালগুলোর খাওয়া হয় না। এর জন্য একামাত্র ছেলে মহরমের কাছ থেকেও টাকা নিতে হয়।

আলেপার সঙ্গে কথা বলার জন্য তার বাড়িতে প্রবেশ করতেই কানে এলো বিভিন্ন নাম। প্রথমে মনে হয়েছিল কোনো মানুষকে তিনি ডাকছেন। ভেতরে প্রবেশ করতেই চক্ষু চড়কগাছে!

যেমনটা মা’র ডাকে সন্তানরা ছুটে আসে, তেমনি আলেপার এমন মধুর ডাকে একের পর এক বিড়ালগুলো ছুটে এলো তাদের মা’র সাজানো খাবার খেতে। চোখ আটকে যায় একেক জনের জন্য একেকটা থালায় থরে থরে সাজানো মাছ-ভাত দেখে। এ সময় আলেপা খাতুন বিড়ালগুলোর উদ্দেশ্যে বলছিলেন, ‘বাবা কনে গেছিলা, বাবা ভাই কনে? খাও বাবা খাও।’

কোনো হিংসা বা মারামারির বালাই নেই। বিড়ালগুলো আপন মনে খেয়ে চলেছে তাদের ‘মা’র হাতের সাজানো খাবার।

আলেফা বলেন, ‘আমিই ওদের ‘মা’। আমি ছাড়া ওদের দেখপি কে? প্রতিদিন আড়াই কেজি চালের ভাত আর সাথে ৮০/৯০ টাকার মাছ লাগে আমার এসব ছেলে-মেয়েদের (বিড়াল) জন্য। এখন এদের সংখ্যা বাচ্চাসহ ৪১টা। এর আগে আরও বেশি ছিল কিন্তু কুকুর মেরে ফেলেছে বেশ কিছু। এছাড়া ছিল বেজি। কিন্তু মানুষ সেগুলো বিষ দিয়ে মেরে ফেলেছে। টাকি মাছ বেশি পচ্ছন্দ করে আমার ছেলেগুলো (বিড়াল)। খায় ছিলবার কাপ/লোয়ারি মাছও। ছোট মাছ কম খায়। দিনে ৫/৬ বার খাবার দিতে হয় বলেন আলেপা।

‘রাতে উয়্যারে (ওদের) জন্যি (জন্য) ভালোভাবে ঘুমাতেও পারি না। মারামারি লাগলি আমার ঘুম থেকে উঠে গিয়ে উয়েরেক শাসন করা লাগে। তখন ওরা মারামারি বন্ধ করে। আবার শাসন করলি উয়্যারা পা চ্যাপা (চেপে) ধরে। উয়েরে জন্যি আলাদা বাসন-কোসন। আলাদা রান্না করি। মসলা কম কম দেয়া লাগে। বেশি মসলা দিলে উয়্যারা খ্যাবির (খাবার) পারে না।’

প্রতিদিন খরচ কত হয় জানতে চাইলে আলেপা বলেন, ‘আড়াই কেজি চালের ভাত, একপোয়া দুধ ও মাছ লাগে। তাতো ২৫০ টাকার নিচে হয় না। আমার ঘরেই ওরা থাকে। খাটে ও মেঝেতে বিছানা প্যাড়া দিই। মশারি টাঙ্গায়া দিই। ছোটবেলা থেকেই আমি এসব ভালোবাসি। ওরা অবলা প্রাণি। উয়েরে জন্যি ভীষণ মায়া লাগে আমার। উয়েগারে ছ্যাড়া আমি থ্যাকপার (থাকবার) পারবো না। রাত ২টা পর্যন্ত জাগা লাগে উয়েগারে লাগে। খুঁজা লাগে। ঘুড়্যা বেড়ায় বাড়ি বাড়ি। উয়েগারে শুয়ায়ে তারপর আমি শুই। আমি খাবার লিয়ে (নিয়ে) গেলি তবে ওরা খায়। আর কারও তা খায় না।’

তিনি বলেন, ‘ওরা পশু হলিও সব বোঝে। খালি মানুষই মানুষেক ভালো বোঝে না। ভালো চায় না।’

স্বামী-সন্তানদের কথা জিজ্ঞেস করতেই এবার একটু আবেগী হয়ে ওঠেন আলেপা খাতুন। তিনি বলেন, ‘বাপ-মা ছোট কালে বিয়্যা দিছিল। সংসার কি জিনিস বুঝব্যার পারি নাই। ২৬ বছর আগে গর্ভে সন্তান (মহরম) থাকতেই স্বামী আমাক ছ্যাড়ে (ছেড়ে দেয়) চলি যায়। ছাওয়ালেক (মহরম) অনেক কষ্টে মানুষ করিছি। সে এখন রাজমিস্ত্রীর কাজ করে। কিছুদিন আগে ছাওয়ালের বিয়্যাও দিছি। আছি উয়েরেক নিয়্যা আর….মানুষকে নিয়্যা। সবাই আমাক ভালোবাসে। ভোটে দাঁড়ালাম, মানুষ ভোট দিল মেলা করে। কাউন্সিলর হলেম। প্রতিদিন এলাকার মানুষদের কাছে যাই খোঁজ-খবর লেই। এলাকার মানুষ আমাক খুব ভালোবাসে।’

বিড়ালগুলো সারাদিন বাইরে ঘুরে বেড়ালেও রাতে তাদের ‘মা’র (আলেপা) কাছেই ঘুমায়। আলেপা বলেন, বিড়ালগুলোর অসুখ হলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া লাগে, আবার ওষুধ কেনা লাগে। শীতের মধ্যে বেশি কষ্ট হয়। উয়ারে জন্যি একটা ঘর হলে ভালো হয়, কিন্তু টাকা পাবো কনে? উয়েরেক খাওয়াবো না ঘর বানাবো!

প্রতিবেশীরা সবাই সমান মনের না। আলেপার বিড়াল নিয়ে কারবার অনেকেই বাঁকা চোখে দেখেন। মাঝে মধ্যে এনিয়ে প্রতিবেশীদের সাথে বিবাদও হয়। সেটা অনেক দূর গড়ায়। তবুও তিনি সব কিছু উপেক্ষা করে তার সন্তানদের (বিড়াল) অন্ন জুগিয়ে চলেছেন।

কথা হয় দোলবেদীতলার (৬ নং ওয়ার্ড) রনি রায় ও সন্দ্বীপ কর্মকারের সঙ্গে। তারা বলেন, আলেপা আপা খুব সাদামাটা জীবন যাপন করেন। প্রতিদিনই আমাদের সঙ্গে দেখা করেন, খোঁজ খবর নেন। এছাড়াও কোন বাড়ির কেউ অসুস্থ হলে বা মারা গেলে সবার আগে পৌঁছে যান ‘আমাদের’ আলেপা আপা।

পৌর শহরের ৪নং ওয়ার্ডের পুরুষ কাউন্সিলর ও তার প্রতিবেশী রাজ আলী জানান, আমরা ছোটবেলা থেকেই আপাকে (আলেপা) দেখে আসছি। তার এই পশুপ্রেম দেখে আমরা মুগ্ধ। অনেক কষ্টে চলে তার সংসার। কিন্তু কোনো সময় কাউকে তিনি তা বুঝতে দেন না। বিড়ালগুলোই তার সবকিছু।