পথ তারার ইশকুল ব্যাপক সারা ফেলছে সর্বএ
নিজস্ব প্রতিনিধি : অন্যরকম একটা স্কুল। নাম ‘পথ তারার ইশকুল’। অবস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের রেল স্টেশন। এটি প্রতিষ্ঠার পেছনে আছে মজার গল্প। প্রতিষ্ঠাতা আফনান আলম সাকিবের মুখেই শোনা যাক সেই গল্প।
শুরুর দিকে এই ধরনের চিন্তা ছিল না যে আসলেই এটা একটা স্কুল হয়ে যাবে বা এখন যেভাবে আছে এমন কিছু একটা হবে। আমরা ফ্রেন্ডরা প্রতিদিন স্টেশনে চা খেতাম, বিকালে স্টেশনে বাচ্চাদের সাথে ফান করতাম। ইট দিয়ে লিখতে বলতাম। কাউকে নাম লিখতে বলতাম, কাউকে অ আ। লিখতে পারলে চকলেট দিতাম। একদিন মাথায় আসলো আমরা ওদের জাস্ট নাম লিখা শিখাবো। প্ল্যান করলাম পরদিন আসবো সকালে। কারণ সকালেই ফ্রি। প্রাইভেট, স্কুল থাকে না। তারপর আসলাম পরদিন সকালে। সকালে আসার মাঝে ছিল অনেক ইতিহাস। সকালে নিয়ে আসার জন্য আমাদের কিছু খাবার, আর একটা চাটি দরকার ছিল। আমাদের সবার কাছে ভালো রকমের টাকা ছিল, বাট আমরা কেউ বের করতে রাজি না। আমি বলতাম তুই দে, আর একজন বলতো তুই দে।
তারপর ওখানে সিদ্ধান্ত নিলাম চাটি চুরি করতে সদর হাসপাতালে যাবো। কারণ সদরে অনেক চাটি পড়ে থাকে আমাদের জানা ছিল। তারপর গেলাম, অনেক চেষ্টা করেও পেলাম না। তারপর রাগ করে আমি টাকা বের করি, ১০০ টাকা দিয়ে চাটি কিনি। যাই পরদিন সকালে স্টেশনে।
দিনটা ছিল ২০১৫ সালের ১১ নভেম্বর। সকালে গেলাম স্কুলে। যাওয়ার কথা ছিল আমরা ৭ বন্ধুর। বাট সকাল হওয়ায় আসলো মাত্র ৩ জন (অন্ত, রুবেল, আমি)। তখন খুব শীত ছিল। সাথে নিয়ে যাই চকলেট, বিস্কুট, পেনসিল,কলম আর চাটিটা বসার জন্য। তারপর একটা জায়গা সিলেক্ট করে ওখানে রুবেলকে এই জিনিসগুলো নিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে আমি ডানদিকে এবং অন্ত বামদিকে চলে যাই বাচ্চা যোগাড় করতে। অন্ত ঠিকভাবেই বাচ্চাদের বলছিলো। বাট আমি গিয়ে বাচ্চাদের বিভিন্ন ধরনের লোভ দেখাই যাতে ওরা আসে। চকলেট দেব, আইসক্রিম দিব। ওরা মনে করে আমরা পাচারকারী, দৌড়ে চলে যায় বাসায়।
কিছুক্ষণ পর দেখি ওদের ফ্যামিলিসহ অন্যান্য লোকজন নিয়ে আমার দিকে আসছে। হাতপ দা, বঁটি। দিলাম দৌড়। এক দৌড়ে বাসায়। অন্তও দেখলো অবস্থা, দেখে অন্তও বাসায় দৌড়। তারপর ওই রুবেলকে যে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলাম ওকে ওরা ধরে ফেলে। পাচারকারী মনে করে বেঁধে রাখে স্টেশনে। তার প্রায় দুই ঘন্টা পর রুবেল আমাকে কল দিয়ে বলে, দোস্ত বাঁচা আমারে, পুলিশে ধরায় দিব আমাকে।
পুরো এলাকার বড় ভাইয়েরা স্টেশন গিয়ে রুবেলকে ছুটিয়ে নিয়ে আসে। তারপর ওখানে সবাইকে বলে আসে আমরা স্কুল করবো। এই ঝামেলার কারণে আর একমাস স্টেশনেই যাইনি আমরা। তারপর একদিন আমি ভাবলাম স্কুল খোলার কথা সবাইকে না বলে চলে এসেছি, ব্যাপারটা কেমন হলো! তারপর অন্তকে বলি, রুবেলকেও বলি। রুবেল আর আসেনি। কিন্তু অন্ত রাজি হয়। তারপর অন্তকে নিয়েই বলতে গেলে স্কুল শুরু। প্রতিদিন আমি স্কুলে যেতাম। খুব ঠাণ্ডা ছিল তখন। আর সাথে বৃষ্টিও পড়তো। বাট আমি প্রতিদিন যেতাম। গিয়ে ক্লাস নিতে না পারলেও বাচ্চাদের সাথে নিয়ে কোথাও আড্ডা দিতাম। কোনোদিন অন্ত আসতো, কোনোদিন আসতো না। কিন্তু আমি সাতদিনই যেতাম কারণ সকালে আমার প্রাইভেট ছিল না,আর ফ্রি ছিলাম।
এভাবে প্রায় ২/৩ মাসের মতো যাওয়ার পর আস্তে আস্তে চিন্তা আসলো কিভাবে স্কুলকে আরও ডেভেলপ করা যায়। ত্রিপাল কিনা, বাঁশ বসানো— সব আমরা নিজেরাই করতাম নিজেদের টাকায়। তারপর স্কুলে বাচ্চা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। একসময় আমরা ফেসবুকে একটা গ্রুপ খুলে স্কুলের ছবি পোস্ট করা শুরু করি। এগুলো দেখে অনেকে আমাদের সাথে কাজ করতে আসে।
তারপর সবাইকে নিয়ে কাজ করতে করতে এখন প্রায় একবছর চলে যায়। আমাদের স্টুডেন্ট এখন উপস্থিত থাকে প্রতিদিন ৭০/৮০ জন। যেখানে প্রথম দিন ছিল মাত্র একজন। এখনও এভাবেই চলছে ‘পথ তারার ইশকুল’। বাচ্চাদের বই, খাতা, পেনসিলসহ যাবতীয় লজিস্টিক সবকিছু আমরাই দেই।