মঙ্গলবার, ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ইং ২রা ফাল্গুন, ১৪২৩ বঙ্গাব্দ

সরাইলে ১৫ গ্রামের ভরসা ৭’শ ফুট বাঁশের সাঁকো

AmaderBrahmanbaria.COM
ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৭

মাহবুব খান বাবুল, সরাইল (ব্রা‏হ্মণবাড়িয়া) থেকে : সরাইল উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে ভৌগলিক ভাবে বিচ্ছিন্ন ৪-৫টি ইউনিয়ন। এগুলোর মধ্যে অরুয়াইল ও পাকশিমুল অন্যতম। মেঘনা ও তিতাস পাড়ের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন সেখানকার গ্রাম গুলোর মানুষের জীবন মান খুবই কষ্টের। শুস্ক মৌসুমে পায়ে হাঁটা ও বর্ষায় নৌকাই তাদের যাতায়তের প্রধান মাধ্যম। ২ ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে তিতাসের শাখা ‘সেতরা’ নামক নদী। আর সেই সেতরা নদীর উপরই জনস্বার্থে স্থানীয় লোকজনের উদ্যোগে তৈরী হয়েছে ৭’শ ফুট লম্বা একটি বাঁশের সাঁকো। সেখানকার ১৫ গ্রামের মানুষের যোগাযোগের একমাত্র ভরসা এখন সাঁকোটি। এ ছাড়া ভৈরব ও বাজিতপুর উপজেলার লোকজনও এ সাকো ব্যবহার করছেন। সরজমিনে স্থানীয় লোকজন সূত্রে জানা যায়, অরুয়াইল বাজারের দক্ষিণ পাশে বিএডিসি’র জায়গা ঘেষে প্রবাহিত হয়েছে সেতরা নদী। শুস্ক মৌসুমে অরুয়াইল ইউনিয়নের অরুয়াইল, রানিদিয়া, কাকুরিয়া, রাজাপুর, বাদে অরুয়াইল, বারপাইকা, বুনিয়ারটেক, ধামাউড়া, দুবাজাইল পাকশিমুল ইউনিয়নের পাকশিমুল, ফতেহপুর, পরমানন্দপুর, হরিপুর, ষাটবাড়িয়া ও বড়–ইছাড়া গ্রামের অধিকাংশ লোকজন নিজ এলাকায় পায়ে হেঁটে চলাচল করেন। সেতরা নদীতে ওই সময়ে প্রথমে পানি ও পরে কাঁদায় পানিতে থাকে একাকার। পারাপারে লোকজনকে পোহাতে হতো অবর্ণনীয় দূর্ভোগ। তখন ১৫ গ্রামের বাসিন্ধারা একে অপরের স্বজনদের বাড়িতে স্বাচ্ছন্ধে যাতায়তে বাঁধা ছিল সেতরা নদী। অধিকাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কলেজ অরুয়াইলে গড়ে ওঠায় ৫-৬ গ্রামের শিক্ষার্থীদের যাতায়তেও এই সেতরাই ছিল কষ্টের কারন। আবার ভৈরব উপজেলার খলাপাড়া, মেন্দিপুর, সাদেকপুর, আগানগর, জাফরনগর, শ্রীনগর ও বাজিতপুর উপজেলার নোয়াআডা, কইটুপি, মধ্যচর ও কামারবাল্লি গ্রামের বেশ লোক মেঘনা পার হয়ে এ সাঁকোর উপরে দিয়ে সরাইল হয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছেন।

এসব দূর্ভোগের কথা চিন্তা করে ৮ গ্রামের লোকজন মিলে বড় ১টি নৌকাটি দেন। মাঝি বাড়ির কটু মাঝি ওই নৌকায় করে সারা দিন লোকজনকে পারাপার করতো। বিনিময়ে বৈশাখ মাসে ৮ গ্রামের লোকজন কটু মাঝিকে ১ কানি জমি থেকে ৫ সের করে ধান দিত। এ ভাবে চলল অনেক দিন। নৌকাটি বড় হওয়ায় উভয় পাড়ে শুকনো জায়গায় নামা যায় না। নামতে হয় পানিতে। কাঁদা পানি ভেঙ্গে আরেক দূর্ভোগ। পরে বড় নৌকা তুলে দিয়ে ছোট ডিঙ্গি নৌকা দেওয়া হয়। জনপ্রতি ২৫ পয়সার বিনিময়ে চলে পারাপার। ৮০’র দশকের শেষের দিকে রানিদিয়া গ্রামের আবদুল হেকিমের ছেলে মজর মিয়া প্রথম সেতরা নদীর উপর ২০০ ফুট লম্বা সরু একটি বাঁশের সাঁকো তৈরী করেন। তখন পারাপাড়ের জন্য জনপ্রতি দিতে হত ৫০ পয়সা। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ওই সাঁকোটির পরিধি বৃদ্ধি পেতে থাকে। রানিদিয়া গ্রামের ৬ বড় গোত্রের দরিদ্র পরিবারের ১০জন ও ছোট গোত্রের ৬ জন সম্মিলিত ভাবে দীর্ঘদিন ধরে এ সাঁকোটি মেরামত ভাড়া আদায় সহ সকল কাজ করে আসছে। পর্যায়ক্রমে ২ জন করে প্রত্যেক বছর এটি পরিচালনা করে আসছেন। এখন সাঁকোটির দৈর্ঘ্য প্রস্থ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। বাঁশ তরজা ও কাঠ দিয়েই নির্মিত এ সাঁকো। বর্তমানে সাঁকোটির দৈর্ঘ্য ৭০০ ফুট আর প্রস্থ ৬ ফুট। নদীর উপর বিশাল বড় বাঁশের সাঁকো খুবই সুন্দর দেখায়। দূর দূরান্তের লোকজন প্রথম দর্শনে আশ্চর্য্য ও অভিভূত হয়ে পড়েন। ১০-১২ বছর আগে এটি নির্মাণ করতে ব্যয় হয়েছিল ৩-৪ লাখ টাকা। এখন ওই মালামাল ব্যবহার করেই প্রয়োজনে সংস্কারের মাধ্যমে চলছে সাঁকোটি। সাকোর উপর দিয়ে নারী ও শিশুসহ সকলেই দৌড়ে পারাপাড় হচ্ছে। নির্বিঘ্নে পার হচ্ছে আরোহীসহ মটর সাইকেল। জনপ্রতি ভাড়া হচ্ছে ২ টাকা। বছরের কার্তিক মাসে সাঁকোটি বসানো হয়। আর জৈষ্ঠ্য মাসে সাঁকোটি উঠিয়ে ফেলা হয়। মালামাল রাখা হয় পাশের বিএডিসি’র পরিত্যাক্ত ভবনে। বছরের ৭ মাস ১৫ গ্রামের লোকজন শিক্ষার্থীরা নিশ্চিন্তে সাঁকোটি দিয়ে চলাফেরা করেন। এ সাঁকোর প্রথম নির্মাতা মজর মিয়া গত ৪/৫ বছর আগে মারা গেছেন। এ বছর সাঁকোটি পরিচালনা করছেন রানিদিয়া গ্রামের নূর ইমলাম (৫০) ও রফিক মিয়া (৪০)। পরিচালনাকারীরা জানান, বর্তমানে নতুন ভাবে এমন একটি সাঁকো নির্মাণ করতে ব্যয় হবে ১০ লক্ষাধিক টাকা। দৈনিক শিক্ষার্থীসহ আড়াই সহ¯্রাধিক লোক এ সাঁকো দিয়ে যাতায়ত করে থাকে। পণ্য সামগ্রী ও শিক্ষার্থীদের জন্য ফ্রি। যেহেতু এখানে স্থায়ী কোন ব্রিজ নির্মাণ হচ্ছে না, তাই শুধু এখানকার ২ ইউনিয়ন নয় ভৈরব ও বাজিতপুর উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের লোকজনও মেঘনা পাড় হয়ে রাজাপুর কাকুরিয়া গ্রাম দিয়ে এসে এ সাঁকোর উপর দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছেন।

তবে আবদুস সাত্তার ডিগ্রী কলেজ থেকে গত বছর বিএসএস উত্তীর্ণ ছাত্র রানিদিয়া গ্রামের বাসিন্ধা রাফিউল হাসান, অরুয়াইল থেকে এসএসসি ও কলেজ থেকে ডিগ্রী পাস করেছি। ১২ বছরের শিক্ষা জীবনে ২টাকা করে দিয়েই ওই সাঁকো পার হতে হয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য ফ্রি কথাটি মিথ্যা। একই কথা বলেন, অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র জীবন মিয়া ও সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ ছাত্র আল মাসুম। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য লোকজন বলেন, এখানে সরকারি ভাবে পাকা ব্রিজ নির্মাণ না হওয়ায় হাজার হাজার লোক ও শিক্ষার্থীরা শতাধিক বছর ধরে চরম দূর্ভোগে আছেন। আর এ বাঁশের সাঁকোটিই এখন তাদের ভরসা। অরুয়াইল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, সেতরা নদীর উপর পাকা ব্রিজ অত্যন্ত জরুরী। ৪-৫ বছর আগে আড়াই কোটির টাকার বাজেট তৈরী করে আম্বরেলা নামক প্রকল্প বরাবরে আবেদন জমা দিয়েছিলাম। আশার বাণী শুনেছি। শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। বর্তমানে এখানে ব্রিজ করতে ১০ কোটি টাকার মত খরচ হবে। তবে এ অজপাড়া গাঁয়ের লোকজন তাদের শতাধিক বছরের ভোগান্তি থেকে পরিত্রাণ চায়। সরাইল উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী মোঃ এমদাদুল হক বলেন, সেখানকার মানুষের দূর্ভোগের কথা চিন্তা করে ৪/৫ মাস আগে একটি ব্রিজ নির্মাণের ব্যবস্থা করার জন্য আবেদন পাঠিয়েছি। সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দা নাহিদা হাবিবা বলেন, জনস্বার্থে সেখানে ব্রিজ করার জন্য স্থানীয় প্রকৌশলীর সাথে কথা বলে প্রয়োজনে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করব।