অন্তর থেকে দায়িত্ব পালন করেছি : যা করে গেল রকিব কমিশন (ভিডিও)
বিদায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেছেন, তিনি ও তাঁর অধীন নির্বাচন কমিশনাররা অন্তর থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন। নবগঠিত নির্বাচন কমিশনে (ইসি) দায়িত্ব পাওয়া ব্যক্তিরাও একই কাজ করবেন বলে আশা রয়েছে তাঁর।
আজ মঙ্গলবার রাজধানীর উপকণ্ঠ সাভারে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধে বীর শহীদদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন বিদায়ী সিইসি।
গতকাল সোমবার সাবেক সচিব খান মোহাম্মদ (কে এম) নুরুল হুদাকে সিইসি করে পাঁচ সদস্যের নতুন ইসি গঠন করা হয়। এতে কমিশনার হিসেবে রয়েছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব তালুকদার, সাবেক সচিব মো. রফিকুল ইসলাম, রাজশাহীর সাবেক জেলা ও দায়রা জজ কবিতা খানম ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ওই পাঁচজনের নিয়োগে অনুমোদন দিয়েছেন। গতকাল রাত ৯টায় সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব শফিউল আলম বিষয়টি জানিয়েছেন।
ইসিতে নতুন দায়িত্ব পাওয়াদের বিষয়ে জানতে চাইলে রকিবউদ্দীন সাংবাদিকদের বলেন, ‘নতুন যাঁরা এসেছেন, তাঁরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে এসেছেন, এটা সাংবিধানিক দায়িত্ব। দেশের দায়িত্ব, রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং আমরাও এটা অন্তর থেকে পালন করে এসেছি। আমাদের আশা রয়েছে, আস্থা রয়েছে, তাঁরাও যোগ্যতার সাথেই দায়িত্ব পালন করবেন।’
এর আগে সকালে জাতীয় স্মৃতিসৌধে বিদায়ী সিইসিকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) শাহ মিজান শাফিউর রহমান ও নির্বাচন কমিশনার শাহ আলম।
রকিবউদ্দীন স্মৃতিসৌধের শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে এক মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি স্মৃতিসৌধের পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর করেন।
ওই সময় তাঁর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাবেদ আলী, মো. শাহনেওয়াজ, মোহাম্মদ আবু হাফিজসহ আরো অনেকে।কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি) শপথ নেন ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। প্রথম দিনই প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ জানান, স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার মাধ্যমে তিনি তাঁর গুরু দায়িত্ব পালন করবেন।
রকিবউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘আমাদের কাজের মধ্য দিয়েই আমরা সবাইকে তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব।’ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর পর দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। তখন সিইসি বলেন, ‘যেকোনো সিস্টেমের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব।’
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় বহুল আলোচিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ১৫৩টি আসনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট নির্বাচন বর্জন করে।
ব্যাপক সহিংসতার মধ্য দিয়ে হওয়া দশম এ সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়ে ‘৪০ শতাংশ’। নির্বাচন কমিশনের ভোটার উপস্থিতির এই হিসাব দেখে অনেকের ভ্রু কুঁচকে যায়। তবে কমিশন কোনো সমালোচনা গায়ে মাখেনি।
তখন সিইসি রকিবউদ্দীন বলেন, ‘৯৮ শতাংশ ক্ষেত্রে কোনো রকম সহিংসতা হয়নি।’
সাত হাজার নির্বাচন
জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়াও সবমিলে রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশন সাত হাজার নির্বাচনের আয়োজন করে। রাষ্ট্রপতির নির্বাচন থেকে শুরু করে এর মধ্যে রয়েছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন।
রকিবউদ্দীনের কমিশন ২০১৩ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আয়োজন করে। এরপর আয়োজন করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অন্যান্যগুলোর মধ্যে আছে নবম সংসদের শূন্য আসনের সাতটি উপনির্বাচন, দশম জাতীয় সংসদের ৯টি উপনির্বাচন, দশম জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনে নির্বাচন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন ১০টি, সিটি করপোরেশনের উপনির্বাচন-৭টি, পৌরসভা নির্বাচন ২৮৪টি, পৌরসভা উপনির্বাচন ৯৫টি, প্রথম জেলা পরিষদ নির্বাচন ৬১টি, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ৪৮৭টি, উপজেলা পরিষদের উপনির্বাচন ১০টি, উপজেলা পরিষদের সংরক্ষিত নারী সদস্য পদে নির্বাচন ৪৭০টি, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চার হাজার ২৯৪টি এবং ইউনিয়ন পরিষদের উপনির্বাচন এক হাজান ৩৭৩টি।
ছয় ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। ধাপে ধাপে বাড়ে সহিংসতা প্রাণ যায় সাতজনের। অনিয়ম ছিল সর্বত্র। সিইসি বলেন, ‘যেটা হয়েছে সেটা হচ্ছে বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং এটা হবেই।’
২০১৫ সালের শেষ দিকে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে হয় পৌরসভা নির্বাচন।
মেরুদণ্ড বয়ান
এসব স্থানীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রভাব ও মনোনয়ন বাণিজ্য রুখতে না পারায় অভিযোগ ওঠে ইসির বিরুদ্ধে। সমালোচনার মুখে পড়ে কমিশন। কমিশনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেন, ‘মেরুদণ্ড সোজা করে সঠিকভাবে চলার চেষ্টা করুন।’
একই ভাষায় কথা বলেন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যন এইচ এম এরশাদ। তিনি বলেন, ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশন মেরুদণ্ডহীন।’
মেরুদণ্ড বিষয়ক অভিযোগ নিয়ে সাংবাদিকদের সামনে উঠে দাঁড়িয়ে পাল্টা জবাব দেন কমিশনার জাবেদ আলী। তিনি বলেন, ‘সোজা আছে কোমর, অসু্বিধা নেই।’
আরেক নির্বাচন কমিশনার আব্দুল মোবারকও বিতর্কিত হোন। সাংবিধানিক ব্যাখ্যা জানতে চাইলে সাংবাদিকদের তিনি তসলিমা নাসরিনের বই পড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার রেকর্ড
কেবল জাতীয় সংসদ নির্বাচন নয় স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ছিল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের ছড়াছড়ি। প্রথমাবের মতো অনুষ্ঠিত দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও আরেকটি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার রেকর্ড দেখা যায়। পাশাপাশি শতাধিক প্রাণহানি, কেন্দ্র দখল, প্রকাশ্যে সিল মারা ও অনিয়মের কারণে আলোচিত হয় এ নিবার্চনও।
অনিয়মের প্রতিকার চেয়ে প্রার্থীরা আবেদন করলেও নিষ্ক্রিয় থাকে কমিশন। একপর্যায়ে আদালত অবমাননার সাজা থেকে অব্যাহতি পেতে সিইসিসহ চার কমিশনারকে আদালতে দাঁড়িয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হয়।
আইনি জটিলতায় দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয় ২০১৫ সালে। ঢাকাকে বিভক্ত করায় দুই সিটি করপোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একই দিনে হয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন। নানা অনিয়মের অভিযোগে ভোটের দিন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা। ফলে এ নির্বাচনও বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। ঢাকা উত্তর সিটি নির্বাচনে জয়ী হন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আনিসুল হক, ঢাকা দক্ষিণে জয়ী হন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সাঈদ খোকন এবং চট্টগ্রামে জয়ী হন আ জ ম নাছির উদ্দিন। ভোটের দিন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান, তাবিথ আউয়াল, মির্জা আব্বাস ও মোহাম্মদ মনজুর আলম। তিনজনই বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন।
প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদ নির্বাচনেও দেখা যায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ের হিড়িক। নিবার্চনকালীন আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় কমিশন ছিল এ সময় নিস্পৃহ।
শেষ হাসি নারায়ণগঞ্জে
তবে মেয়াদের একেবারে শেষে এসে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে প্রশংসা কুঁড়ায় নির্বাচন কমিশন। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের দ্বিতীয় নির্বাচনে কোনো ধরনের গোলযোগ ঘটেনি। কোনো কেন্দ্র বাতিলও হয়নি। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভি বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেনকে পরাজিত করেন।
পরপর দ্বিতীয়বারের মতো ওই সিটির মেয়র নির্বাচিত হন আইভি।
এর আগে ২০১৩ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত গোলযোগহীন চার সিটির নির্বাচনেও প্রশংসা কুঁড়িয়েছিল রকিব কমিশন।
আগামী কাল শেষ হচ্ছে কাজী রকিবউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি শপথ নিবেন কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নতুন নির্বাচন কমিশন। গতকাল সোমবার কে এম নুরুল হুদাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) করে পাঁচ সদস্যের নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন করা হয়। এতে কমিশনার হিসেবে রয়েছেন সাবেক সচিব মো. রফিকুল ইসলাম, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব তালুকদার, রাজশাহীর সাবেক জেলা ও দায়রা জজ কবিতা খানম ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী।