ফ্লাইওভার নির্মাণ: দ. এশিয়ায় সর্বোচ্চ ব্যয় বাংলাদেশে
নিউজ ডেস্ক : নির্মাণসামগ্রী ও শ্রমিকের মজুরি তুলনামূলক কম হলেও বাংলাদেশে ফ্লাইওভার নির্মাণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে। তুলনামূলক নির্মাণ খরচ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ফ্লাইওভার নির্মাণের ক্ষেত্রে ভারত, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এমনকি চীন ও মালয়েশিয়ার চেয়েও প্রায় দ্বিগুণ খরচ হচ্ছে। এ চিত্র ক্ষেত্রবিশেষে কম-বেশি রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে অবগত হলেও নির্মাণ ব্যয় সংকোচনের বিষয়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, চার লেনের এক কিলোমিটার ফ্লাইওভার নির্মাণ করতে বাংলাদেশে খরচ হচ্ছে গড়ে ১২৩-২৫০ কোটি টাকা। প্রতিবেশী দেশ ভারতে এ দূরত্বের ফ্লাইওভার নির্মাণে করতে খরচ হচ্ছে ৯০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা। আর পাকিস্তানে ৬০ থেকে ১১০ কোটি টাকা, মালয়েশিয়ায় ৬০ থেকে ১৩০ কোটি টাকা এবং চীনে ৯০ থেকে ১৩০ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফলতি, ভুল পরিকল্পনা, সময়মতো কাজ শুরু ও শেষ করতে না পারা, দীর্ঘসূত্রতা এবং কার্যকর জবাবদিহিতা না থাকায় খরচ অস্বাভাবিক রকমের বেশি হচ্ছে। এ ছাড়া জমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন, আইনি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে প্রকল্প বিলম্বিত হয়, যার ফলে দুর্নীতি হচ্ছে। আর এসব সামগ্রিক অব্যবস্থাপনার কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দাতা সংস্থার ঋণ ও প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতার কারণে বাংলাদেশে ফ্লাইওভার নির্মাণের ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে তুলনামূলক বেশি। এ ব্যয় কমিয়ে আনতে হলে ঋণনির্ভর প্রকল্প বাদ দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প সম্পাদন করতে হবে। একই সঙ্গে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প শুরু ও শেষ করতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, এসব প্রকল্পে দুর্নীতি হয় না, সেটা বলা যাবে না। তবে সেটা (দুর্নীতি) তো গোপনীয়। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শুরু ও শেষ করতে পারলে দুর্নীতির সুযোগ অনেকাংশে কমে যাবে।
জানা গেছে, ২০১১ সালের জানুয়ারিতে আট কিলোমিটার দীর্ঘ মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার প্রাথমিক টার্গেট ছিল। কিন্তু সেটা করতে পারেনি নির্মাণ সংস্থা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)। ধাপে ধাপে সময় বাড়িয়ে আগামী জুনের মধ্যে প্রকল্পের সব কাজ শেষ করার ঘোষণা দিয়েছে এলজিইডি।
এ প্রকল্পের প্রাথমিক নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭৭৩ কোটি টাকা। পরে তা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২১৯ কোটি টাকায়। শুরুতে চার লেনবিশিষ্ট এ ফ্লাইওভারের প্রতি কিলোমিটারের নির্মাণ ব্যয়ের টার্গেট ছিল ৯৩ কোটি টাকা। পরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২০ কোটি টাকায়। প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ কোটি টাকা।
এটা আরও বাড়বে কিনা সেটা নিয়েও সংশয় রয়েছে। যদিও এ ফ্লাইওভার প্রকল্পের পরিচালক সুশান্ত কুমার পাল যুগান্তরকে জানিয়েছেন, এ প্রকল্পের সময় কিংবা ব্যয় কোনোটিই বাড়ানো হবে না।
এর চেয়েও ভয়াবহ চিত্র লক্ষ্য করা গেছে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার প্রকল্পের ক্ষেত্রে। শুরুতে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৫০ কোটি টাকা। পরে ধাপে ধাপে এ প্রকল্পের ব্যয় ৬ গুণেরও বেশি বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আরও জানা গেছে, ১৯৯৮ সাল থেকে মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ শুরুর প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হয়। নানা টানাপোড়েনে কাজ শুরু হয় ২০১০ সালে। প্রথম পরিকল্পনায় এ ফ্লাইওভারের দৈর্ঘ্য ছিল ৩ কিলোমিটার। পরে ফ্লাইওভারের দৈর্ঘ্য বেড়ে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ১৭ কিলোমিটার। ২০১৩ সালে ফ্লাইওভারের একটি অংশ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ধাপে ধাপে হানিফ ফ্লাইওভারের অন্য সব লুপ খুলে দেয়া হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের প্রতি কিলোমিটারের নির্মাণ খরচ হয়েছে ২৩০ কোটি টাকা। অথচ শুরুতে নির্মাণ ব্যয় ধার্য করা হয়েছিল প্রতি কিলোমিটারে প্রায় ১২০ কোটি টাকা। শুরুর তুলনায় প্রতি কিলোমিটারে ১১০ কোটি টাকা বেশি ব্যয়ে প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়। কুড়িল ফ্লাইওভারে প্রতি কিলোমিটার নির্মাণে খরচ হয়েছে ১১৪ কোটি টাকা এবং মিরপুর-বিমানবন্দর ফ্লাইওভারের প্রতি কিলোমিটার নির্মাণে খরচ হয়েছে ৯৯ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটারের সম্ভাব্য নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ২৫৫ কোটি টাকা।
এর বিপরীত চিত্র লক্ষ্য করা যায় ভারতের দিল্লিতে ফ্লাইওভার নির্মাণ ক্ষেত্রে। ওই শহরে দুই লেনের ২ কিলোমিটার ফ্লাইওভার নির্মাণে ভারত সরকার খরচ করেছে ৪৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা। যার প্রতি কিলোমিটারের খরচ হয়েছে ২৩ কোটি টাকার চেয়ে একটু বেশি। পাকিস্তানের পেশোয়ারে ২ দশমিক ১২ কিলোমিটারের একটি ফ্লাইওভার নির্মাণে খরচ হয়েছে ১৩০ কোটি টাকা। যার প্রতি কিলোমিটার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৬১ কোটি টাকা।
মালয়েশিয়ায় বর্তমানে দুটি ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ চলছে। দুটি ফ্লাইওভারের প্রতি কিলোমিটার নির্মাণে খরচ হচ্ছে ৬১ কোটি টাকা করে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে ওই দেশগুলোতে নির্মাণ খরচ কিছুটা কম-বেশি হয়ে থাকে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ফ্লাইওভার নির্মাণে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে বাংলাদেশে। যুগান্তর