নিজস্ব প্রতিবেদক : বিদেশে বিপুল চাহিদা থাকার আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে আছে সম্ভাবনাময় বালু রপ্তানি। অথচ প্রতিবছর এক কোটি ট্রিলিয়ন কিউওসেক ঘনফুট বালু রপ্তানি করে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা সাত হাজার ৮শ কোটি টাকা আয় করার সম্ভাবনা রয়েছে।
উল্লেখ্য, বালু মহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন-২০১০ এবং বিধিমালা ২০১১তে বালু রপ্তানির কথা উল্লেখও রয়েছে। তাছাড়া বালু রপ্তানির নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়ে আছে আট বছর আগেই। পাশাপাশি সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও মালদ্বীপসহ বেশ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশ থেকে বালু আমদানিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, বালু রপ্তানির ব্যাপারে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিকভাবে অনাপত্তি পাওয়া গেলেও ভূমি মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত মতামত দেয়নি। সূত্র মতে, খাসিয়ার খালসহ অন্যান্য নদী বা খাল থেকে খনন করে বালু দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রপ্তানি করা যেতে পারে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
জানা গেছে, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রপ্তানি) শওকত আলী ওয়ারেছির নেতৃত্বে ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করা হয়। সম্প্রতি এই কমিটি এক কোটি ট্রিলিয়ন কিউওসেক ঘনফুট বালু রপ্তানি করা যেতে পারে বলে মত দেয়। যা থেকে বছরে ৭ হাজার ৮শ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।
একই সঙ্গে কমিটি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের মতামত জানতে চেয়েছে। এসব মন্ত্রণালয়ের মধ্যে রয়েছে ভূমি, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ, পরিবেশ ও বন এবং নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে বালু রপ্তানির ব্যাপারে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিকভাবে অনাপত্তি পাওয়া গেলেও ভূমি মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত দেয়নি।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে এ বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভূমি মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে একটি নীতিমালা তৈরিসহ অনাপত্তি চেয়ছে। যেখানে বালু মহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০ ও বিধিমালা ২০১১ আছে সেখানে কোনো নীতিমালার প্রয়োজন নেই। আর আইন ও বিধিমালায় রপ্তানির কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়লে রপ্তানি করা যাবে না। এছাড়া বালুর সঙ্গে খনিজ পদার্থ সিলিকন ও টাইটোনিয়াম রয়েছে যা স্বর্ণের থেকেও অনেক মূল্যবান। রপ্তানিযোগ্য বালুর মধ্যে যাতে মূল্যবান খনিজ পদার্থ চলে না যায় এবং পরিবেশের ওপর কোন ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব না পড়ে সে বিষয়গুলো লক্ষ্য রেখে বালু রপ্তানি করলে কোন বাধা থাকবে না।
তিনি বলেন, বালু রপ্তানির বিষয়ে খনিজ ও জ্বালানি সম্পদ মন্ত্রণালয়কে এই খনিজ পদার্থ আলাদা করার বিষয়ে উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে। বালু রপ্তানি করতে গেলে আমরা যতই ব্যবস্থা নেই না কেন, খনিজ পদার্থ চলে যাবেই। যা দেশ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক। এজন্য বালু রপ্তানি নিয়ে এই মুহূর্তে ভাবছে না ভূমি মন্ত্রণালয়। এছাড়া আমাদের দেশে এখন অনেক বালুর চাহিদা রয়েছে। সরকার দেশের উন্নয়নে পদ্মা সেতু, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রকল্পসহ অনেক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যেখানে অনেক বালুর প্রয়োজন রয়েছে।
এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন বলেন, বালু রপ্তানির বিষয়ে ৮ বছর আগেই একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দেশের নদ-নদীতে যে পরিমাণ বালু রয়েছে তাতে শর্ত সাপেক্ষে বালু রপ্তানি করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, কী পরিমাণ খনিজ পদার্থ থাকলে তাকে সম্পদ বলা যায় সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে। দেখা গেল আমরা যেখান থেকে বালু রপ্তানি করছি সেখানে খনিজ পদার্থের পরিমাণ কম রয়েছে যা পরিবেশর জন্য কোন হুমকি হবে না। সেখান থেকেই কেবল বালু রপ্তানি করা হবে।
তিনি বলেন, আমরা বালু রপ্তানি করলেও তা ব্যাপক আকারে করব না। জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হবে না। আমরা চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট স্থান থেকে ভূমি মন্ত্রণাললয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে বালু সংগ্রহ করে রপ্তানি করব। এক্ষেত্রে পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও ভূমি মন্ত্রণালয় স্থান ঠিক করে দিবে। পাশাপাশি পরিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কি না তা পরীক্ষা করবে। যে স্থান থেকে বালু রপ্তানি করা হবে সেখানে প্রয়োজনে প্রশাসন দিয়ে পাহারা দেয়া হবে। যাতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বালু উত্তোলন না করা হয়। একই সঙ্গে বর্ডার পার হওয়ার সময় পুনরায় বালু পরীক্ষা করা হবে। এছাড়া আমাদের নদ-নদীতে প্রতিবছর যে পরিমাণ বালু পড়ে তাতে নদীগুলো নাব্য হারাচ্ছে। নৌ-চলাচলে বাধার সৃষ্টিসহ পলিভূমি নষ্ট হচ্ছে। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে আমরা বছরে এক কোটি ট্রিলিয়ন কিউওসেক ঘনফুট বালু রপ্তানি করতে পারব। এর ফলে আমাদের ভূমির উর্বরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নদীগুলো নাব্য ফিরে পাবে। এজন্য সরকার বেসরকারি খাতকেও উৎসাহিত করছে। তারা এগিয়ে এলে দেশ থেকে বালু রপ্তানি হতে পারে।
এদিকে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বালুতে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদ রয়েছে। কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারি থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত চারটি স্থান থেকে আটটি বালুর নমুনা সংগ্রহ করে মূল্যবান খনিজের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এজন্য বালু রপ্তানি ক্ষেত্রে যাতে এসব খনিজ পদার্থ চলে না যায় সে বিষয়ে লক্ষ্য রেখে রপ্তানি করা যেতে পারে বলে জানিয়েছে।
অন্যদিকে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় দেশের স্বার্থের অনুকূল হলে বালু রপ্তানি করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করে জানিয়েছে, ক্রমান্বয় বালু জমা হয়ে অনেক নদী নাব্য হারাচ্ছে। যেসব নদী ড্রেজিং করা হবে তার বালু রপ্তানি করা যেতে পারে। দেশের স্বার্থে এটি হলে নৌ-মন্ত্রণালয়ের আপত্তি নেই।পরিবেশবাদীরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে বালু বা মাটি কোনটাই রপ্তানি করা ঠিক হবে না। এতে দেশের পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। একই সঙ্গে বালুর সঙ্গে অনেক মূল্যবান খনিজ পদার্থও বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শর্তসাপেক্ষে বালু রপ্তানির সুযোগ দেয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপসহ কয়েকটি দেশে বালু রপ্তানির জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি চেয়েছে কয়েকটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। সরকার বিষয়টি ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে। সাগরবেষ্টিত সিঙ্গাপুর ভূখণ্ড বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করবে বাংলাদেশের বালু। আর মালয়েশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া নির্মাণ কাজের কাঁচামাল হিসেবে নিতে চায় অপ্রচলিত এই পণ্যটি। তবে এটি অপ্রচলিত হলেও সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধিতে সাগরের পানির আগ্রাসনে ভীত বাংলাদেশের উপকূলকে কতখানি বিপদাপন্ন করে তুলতে পারে তা নিয়ে ভাবনায় পরিবেশবাদীরা।
উল্লেখ্য, ২০১০ সালে ঢাকা সফরকালে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ থেকে বালু আমদানির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে প্রস্তাব দেন। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের নদী ড্রেজিং করে মালদ্বীপকে মাটি রপ্তানির প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর পরিকল্পনা কমিশন বালু রপ্তানির বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রপ্তানির পক্ষে মতামত দেয়। এর আগে ২০০৭ সালে সিঙ্গাপুরে বালু রপ্তানির বিষয়ে সে দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রথম অনুরোধ করে।