স্পোর্টস ডেস্ক : পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা…এরপর কে? উত্তরটা হতে পারত ইংল্যান্ড। কিন্তু ২৭৭ রান করেও যে জেতা গেল না আরেকটি সিরিজ জয়ের ম্যাচ! জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে সর্বোচ্চ রান তাড়া করে ওয়ানডে জয়ের রেকর্ড গড়ে জস বাটলাররা ম্যাচ জিতে নিল ৪ উইকেটে, ২-১ এ জিতল সিরিজ। ২০১৪ সালের নভেম্বর থেকে টানা ছয় সিরিজ জেতার পর এই প্রথম ‘চ্যাম্পিয়ন’ লেখা বোর্ডের পেছনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা হলো না মাশরাফির দলের।
গত বছর তিন বড় দলকে হারানোর পর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে বড় বড় দলগুলোই যখন একের পর এক বাঘের থাবায় লুটিয়ে পড়ছে, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয় তো অবধারিতই ছিল। ‘এরপর কে’ প্রশ্নটা তাই বড় কোনো দলের নামই প্রত্যাশা করছিল। চট্টগ্রামে সিরিজের শেষ ম্যাচে ইংল্যান্ডের ৪ উইকেটের জয়ে আপাতত সেই প্রত্যাশার সমাপ্তি।
২৭৮ রানের লক্ষ্য কখনোই কঠিন মনে হয়নি ইংল্যান্ডের জন্য। জেমস ভিন্স আর স্যাম বিলিংসের ৬৩ রানের ওপেনিং জুটির পর দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে বিলিংস-ডাকেট মিলে করেন আরও ৬৪। ২৫ ওভারে ১৩০ হয়ে যায় মাত্র ২ উইকেট হারিয়েই। বাংলাদেশের মতো ইংল্যান্ডের ইনিংসেও ছিল না খুব বড় কোনো ইনিংস বা জুটি। তবে আসল পার্থক্য েয পেশাদারি মনোভাবে! উইকেটের সঙ্গে মানিয়ে লক্ষ্য স্থির রেখে খেলেছেন ব্যাটসম্যানরা। যার শেষটা হয়েছে সপ্তম উইকেট বেন স্টোকস আর ক্রিস ওকসের ৪২ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে। ৪৮তম ওভারের শেষ বলে শফিউল ইসলামকে লং অফ দিয়ে বিশাল ছয় মেরে ম্যাচ শেষ করে দেন ওকস।
ব্যাটসম্যানরা বড় রানের পুঁজি দিলেও বাংলাদেশের বোলাররা নির্বিষ বোলিংই করে েগছেন শেষ পর্যন্ত। ইংল্যান্ডের স্পিনাররা উইকেট থেকে দারুণ সব টার্ন বের করে নিতে পারলেও সাকিব-মোসাদ্দেকরা ব্যর্থ। এর একটা কারণ হতে পারে শিশির। পিচ্ছিল বলে একে তো বল ঠিকভাবে গ্রিপ করতে পারছিলেন না স্পিনাররা। উইকেটও হয়ে যায় ব্যাটিংবান্ধব। স্পিনারদের উইকেট বলতে নাসির হোসেনের নেওয়া ভিন্সের প্রথম উইকেট আর মোসাদ্দেকের নেওয়া বিলিংসেরটি। সে তুলনায় পেসাররাই বেশি সফল। দুই উইকেট করে নিেয়ছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা ও শফিউল। এর মধ্যে মাশরাফি বাংলাদেশি বোলারদের মধ্যে ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি উইকেট (২১৬টি) নেওয়ার রেকর্ডও গড়েছেন। রাতটা শেষ পর্যন্ত বিমর্ষই কাটল তাঁর!
অথচ ইংল্যান্ডের সামনে ২৭৮ রানের লক্ষ্য দেওয়ার পর মনে হচ্ছিল রাতটা বাংলাদেশের হতেও পারে। সে সম্ভাবনা সৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা মুশফিকুর রহিমের। বাজে ফর্ম কাটিয়ে কাল তাঁর প্রতিটি শটেই ছিল ফিরে পাওয়া আত্মবিশ্বাসের ঝলক। নিখুঁত ব্যাটিংয়ের প্রতিচ্ছবি।
২৫তম ওভারে দলের ১২২ রানে মাহমুদউল্লাহর বিদায়, মুশফিক উইকেটে আসেন এরপরই। তবে শুরুর সময়টা ভালো কাটেনি। এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে দেখেছেন সাব্বির রহমান, সাকিব আল হাসান, নাসির হোসেনের ফিরে যাওয়া। এই তিন ব্যাটসম্যানের মধ্যে ব্যতিক্রম সাব্বির। কারণ তিনি অন্তত উইকেটটা বিলিয়ে আসেননি। বরং তিন নম্বরে নেমে সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছেন আবারও। ৪৬ বলে ৪৯। চতুর্থ উইকেটে মুশফিকের সঙ্গে ৫৪ রানের জুটি। প্রতিটি রানেই সাব্বির ছিলেন সাবলীল। বাউন্ডারিগুলো এল আত্মবিশ্বাসী সব শটে। কিন্তু আদিল রশিদের দারুণ এক টার্নে ফিফটি থেকে মাত্র এক রান আগে হয়ে যান কট বিহাইন্ড। বলতে পারেন, বাংলাদেশ দলের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে এই একজনের উইকেটই নিয়েছে ইংল্যান্ড। অন্য বেশির ভাগ উইকেটই ব্যাটসম্যানরা দিয়ে এসেছেন।
উইকেটের সঙ্গে মানিয়ে ব্যাটিং করাটা ম্যাচে সাব্বিরই প্রথম েদখান। মুশফিকও পরে তাই করেছেন আরও নিখুঁতভাবে। সপ্তম উইকেটে তরুণ মোসাদ্দেককে নিয়ে ৮৫ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি। ইংল্যান্ডের সামনে তাতেই দাঁড়িয়ে যায় ‘বড় লক্ষ্য’। বর্তমান সময়ের আক্রমণাত্মক ক্রিকেটের কথা মাথায় রেখেও ২৭৮-কে বড় লক্ষ্য মনে হচ্ছিল আসলে এই স্টেডিয়ামের ইতিহাসের কারণে। এ মাঠে রান তাড়া করে জেতার সর্বোচ্চ রেকর্ড এত দিন ছিল ২২৬। ২০১১ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই সেটা করে দেখিয়েছিল বাংলাদেশ। আজ ইংল্যান্ড রেকর্ডটা লিখল নতুন করে।
দুই দিনেরও বেশি সময় কাভারে ঢাকা ছিল উইকেট। টসে জিতে ইংল্যান্ড অধিনায়ক সে কারণেই নিলেন ফিল্ডিং। ইনিংসের দশম ওভার থেকে তার সুফলও পেতে লাগলেন। মঈন আলীর বলে টার্নের ইঙ্গিত। বল পড়ে গতি হারাতে লাগল। যত সময় গড়ায়, ব্যাটসম্যানদের জন্য উইকেট যেন ততই মরীচিকা! ব্যাটিং হয়ে পড়ে কঠিন।
ইমরুল কায়েস, তামিম ইকবাল—দুই ওপেনার উইকেটে থিতু হয়েও আউট হয়েছেন বলের গতিতে বিভ্রান্ত হয়ে। বেন স্টোকসের বলে স্কয়ার লেগে সহজ ক্যাচ তুলে দিয়ে মাত্র চার রানের জন্য ফিফটি করতে পারেননি ইমরুল। অথচ এর আগে ওভারেই প্লাঙ্কেটকে মারা দুর্দান্ত ছক্কায় মনে করিয়ে দিয়েছিলেন সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে করা সেঞ্চুরির ইনিংসটাকে। আদিল রশিদের গুগলিতে কাভারে তামিমের (৪৫) দেওয়া ক্যাচও অনেকটা একই রকম বিভ্রান্তিতে মোড়ানো। পরে রশিদের বলেই শর্ট কাভারে ক্যাচ দিয়েছেন মাহমুদউল্লাহও। লেগ স্পিনের সামনে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের দুর্বলতা প্রকাশ পেল আজও। ৪৩ রান দিয়ে আদিল একাই নিয়েছেন ৪ উইকেট।
ব্যাটিংয়ে বাকি দায়িত্বটা প্রায় একাই কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন মুশফিক।
গত বছর নভেম্বরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন। এরপর থেকেই আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না আসল মুশফিককে। সর্বশেষ সাত ইনিংসে সর্বোচ্চ ইনিংস ৩৮ রানের, সেটাও আফগানিস্তানের বিপক্ষে সর্বশেষ সিরিজে। মুশফিকের কাছে ভালো একটা ইনিংস প্রাপ্যই হয়ে গিয়েছিল।
৬২ বলে অপরাজিত ৬৭ রানে চার বাউন্ডারির সঙ্গে এক ছক্কা। ব্যক্তিগত ৪৪ রানে ওকসের বলে স্টোকসের হাতে জীবন পাওয়াটা উদযাপন করেছেন পরের বলটাকেই ডিপ স্কয়ার লেগের ওপর দিয়ে ছক্কা হাঁকিয়ে।
কিন্তু যে উদযাপনের অপেক্ষায় ছিল গোটা দেশ, সেটা আর হলো না। ইংল্যান্ডের সামনে এসে থেমে গেল সিরিজ জয়ের রথ।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ২৭৭/৬ (তামিম ৪৫, ইমরুল ৪৬, সাব্বির ৪৯, মাহমুদউল্লাহ ৬, মুশফিক ৬৭*, সাকিব ৪, নাসির ৪, মোসাদ্দেক ৩৮; রশিদ ৪/৪৩, স্টোকস১/২৪, আলী ১/৪২)
ইংল্যান্ড: ৪৭.৫ ওভারে ২৭৮/৬ (ভিন্স ৩২, বিলিংস ৬২, ডাকেট ৬৩, বেয়ারস্টো ১৫, স্টোকস ৪৭*, বাটলার ২৫, আলী ১, ওকস ২৭*; মাশরাফি ২/৫১, শফিউল ২/৬১, সাকিব ০/৪৫, তাসকিন ০/৪৬, নাসির ১/৫৩, মোসাদ্দেক ১/২২)
ফল: ইংল্যান্ড ৪ উইকেটে জয়ী।
সিরিজ: ইংল্যান্ড ২-১ ব্যবধানে জয়ী।
ম্যাচ সেরা: আদিল রশিদ।
সিরিজ সেরা: বেন স্টোকস।