২রা সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ইং, শুক্রবার ১৮ই ভাদ্র, ১৪২৩ বঙ্গাব্দ
পরবর্তী নারীর মৃতদেহকে ভেঙে ছোট করে শেষযাত্রা!


বকুলজানের এক কাপড়ের জীবন


Amaderbrahmanbaria.com : - ২৭.০৮.২০১৬

 
নিজস্ব প্রতিবেদক : এক কাপড়ের জীবন তার। বাড়িঘর নেই। নেই কোনো স্বজন। থাকেন দোকানের বারান্দায়। দুপুরের খাবার দুটো সিঙ্গারা আর এককাপ চা। সকালে কিছুই খান না। রাতে একটি রুটি খেয়ে ঘুমিয়ে থাকেন ভোরের অপেক্ষায়। মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে বহু ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করেছেন। উপকূলের প্রান্তিকে বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়েছেন প্রতিনিয়ত। বহু কষ্টের ভেতর দিয়ে পার করা জীবনের শেষ বয়সেও তার নেই স্বস্তি।

নাম তার বকুলজান। স্বামী জামাল সরদার। সব হারিয়ে জীবনের শেষ বয়সে এই নারীর স্থান হয়েছে পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা সদরের গা ঘেঁষে বয়ে চলা রামনাবাদ নদীর তীরের খাস জমিতে। অস্থায়ী বসতি। যে কোন সময় উচ্ছেদ হতে পারে। তার চেয়েও বড় কথা নদী তীরের এই ঘরটি জোয়ারের পানিতে ডুবে থাকে। ফলে সেই ঘরে বসবাসও যেন তার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। একমাত্র মেয়ের মৃত্যুর পর ওই ঘরে আর থাকেন না বকুলজান।

ভর দুপুরে একখানা পুরানো ছাপা শাড়ি পরে তালেবনগর আবাসনের রাস্তার ধারে পাথর কুড়াচ্ছিলেন বকুলজান। কখনো পাথর কুড়ানো, কখনো রাস্তা থেকে কাগজ কুড়ানো, আবার কখনো কারও বাসায় কাজের জোগালি। এভাবেই বকুলজানের সময় কেটে যাচ্ছে এখন। অথচ এক সময় পূর্বপুরুষের জমি ছিল। সেই জমি হারানোর পর নৌকায় মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত হন তার বাপ-দাদা। ভাসমান জেলে পরিবারে বকুলজানের জন্ম। মাত্র ১১ বছর বয়সে নৌকার বহরেই ফুফাতো ভাই জামাল উদ্দিনের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। সেখানেই কাটে বেশ কয়েক বছর। নয়নমণি ছিল তার একমাত্র সন্তান। বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু মাত্র চারমাস আগে সেই মেয়েটিও মারা যায়। এরপর থেকে বকুলজান একেবারেই একা।

বকুলজানের জীবনটাই যেন বহুমূখী গল্পে ভরা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। স্বামীর নৌকায় জীবনের একটা বড় সময় কাটালেও সেই নৌকা যুগেরও অবসান হয়েছে অন্তত ৩০ বছর আগে। নদীতে মাছ পাওয়া যায় না বলে ভাসমান এই জেলেদের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। এর ওপর আছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বকুলজান কতবার যে দুর্যোগের কবলে পড়েছেন, তার হিসেব নেই। দুর্যোগের তাণ্ডব জীবন এলোমেলো করে দিয়েছে।
পেশাগতভাবে নৌকায় মাছ ধরলেও এক সময় সেই পেশা হারাতে হয় বকুলজানদের। নদী থেকে উঠে আসেন ডাঙায়। এরই মধ্যে স্বামীকে হারান। অবশেষে থাকার জায়গা না থাকায় একমাত্র মেয়ে নিয়ে বেশ কয়েক বছর ভারতের আজমীর শরীফে কাটিয়ে আসেন। ভিক্ষাবৃত্তিসহ বিভিন্ন ধরনের কাজে যুক্ত ছিলেন তিনি। কিন্তু সেখানেও স্বাভাবিকভাবে জীবন চালানোর কোনো ব্যবস্থা না হওয়ায় আবার ফিরে আসেন পটুয়াখালীর গলাচিপায়। এখন এখানেই বসবাস করছেন।

বকুলজানের জানামতে, তার বাপদাদার ভিটে ছিল পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার বগা এলাকায়। কিন্তু এখন আর তার কোনো অস্তিত্ব নেই। এখন কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই তার। আর ঠিকানা নেই বলে নেই ভোটার পরিচয়পত্র, নেই কোনো নাগরিক অধিকার। স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনারের তরফে দুই ঈদে মাঝে মাঝে কিছু সাহায্য মেলে। এর বাইরে কোনো সহায়তা পান না এই নারী। একাকী জীবনে নানান ধরনের সমস্যায় পড়লেও তার পাশে কেউ দাঁড়ান না। কারো বাসা থেকে পুরানো কাপড় চেয়েচিন্তে এনে পড়েন। এক কাপড়েই চলে জীবন। দুপুরে নদীতে গোসল করে ভিজে কাপড়ে থাকেন। একপাশ রোদে শুকাতে দিয়ে আরেক পাশ পরেন।

ঠিকানাবিহীন মানুষদের জন্য কোনো ধরনের সহায়তা মেলে না। স্থায়ী ঠিকানা কিংবা ভোটার আইডি কার্ড না থাকলে সাহায্যও পাওয়া যায় না। বকুলজান তাদেরই দলে। তার ভাগ্যে কিছুই জোটে না। গলাচিপা শহরে রামনাবাদ নদীর তীরে তালেবনগর আবাসন নির্মাণের সময় বকুলজান এলাকায় ছিলেন না। সে কারণে তার জন্য এখানে আশ্রয়ের ব্যবস্থাও হয়নি।

বকুলজান আঙুল তুলে দেখান, রামনাবাদের তীরে তার একটি ছোট্ট থাকার ঘর আছে। বকুলজানের ভাষায়, উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ২ হাজার টাকা এবং স্থানীয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ২ হাজার টাকা দিয়েছিল। সেই টাকা দিয়ে ঘর তুলেছেন। কিন্তু সে ঘরে থাকার সুযোগ নেই। কারণ জোয়ারের পানিতে সব ডুবে যায়। বকুলজানকে চেনেন তালেবনগর আবাসনের চা-দোকানদার মতি মাষ্টার। রাতে দোকান বন্ধ হওয়ার পর এই দোকানের বেঞ্চে ঘুমান বকুলজান। মতি মাষ্টার বলেন, ‘তার এখন কিছুই নেই। স্বজন বলতে ছিল একটি মেয়ে। কিন্তু মেয়েটি কিছুদিন আগে মারা যাওয়ার পর একেবারেই অসহায়। বিশেষ কোনো সাহায্য সহযোগিতা সে পায় না। ফলে দিন কাটে অতি কষ্টে।’

বকুলজানের সংগ্রামী জীবনের আরেক সাক্ষী গলাচিপায় কর্মরত দৈনিক ‘জনকণ্ঠ’র স্টাফ রিপোর্টার শংকর লাল দাশ। তিনি বলেন, ‘বকুলজান জীবনে অনেক কষ্ট করেছেন। জীবন বাঁচানোর জন্য ভারত পর্যন্ত গিয়েছেন। কিন্তু অবস্থার বদল হয়নি। কষ্টের জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন। স্থায়ী ঠিকানা না থাকায় বকুলজানের মত বহু ভাসমান মানুষ সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হয়।’

বকুলজান জানান, সারাজীবনে তার সঞ্চয় আছে চার হাজার টাকা। স্থানীয় রুহুল আমিন নামে এক ব্যক্তির কাছে এই টাকা গচ্ছিত রেখেছেন। বেশি সমস্যায় পড়লে সেখান থেকে কিছু টাকা আনেন। এভাবেই বকুলজান বেঁচে আছেন। শেষ বয়সেও স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা মিলল না। শেষ জীবনে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুই চান বকুলজান। তার কণ্ঠে সেই দাবি, ‘মোরে এটটু থাহার জাগা দেন, আর কিচ্চু চাই না।’।





Loading...


প্রকাশকঃ মোঃ আশ্রাফুর রহমান রাসেল
সম্পাদকঃ জাবেদ রহিম বিজন
চেয়ারম্যান : আলহাজ্ব নুরুজ্জামান
ঠিকানা : ৬০৩ ফুলবাড়িয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
email : [email protected] (news)
Phone: +880851 62307
+8801963094563


close