৪৫ বছরের মানসিক প্রতিবন্ধী নারীসহ ১০০ ধর্ষণ ৫ বছরে
---
চলতি বছরের প্রথমদিন। কায়েতপাড়া ইউনিয়নের মাঝিনা পশ্চিমপাড়া এলাকার একটি টেক বিলে পাওয়া যায় ৪৫ বছরের মানসিক প্রতিবন্ধী নারীর লাশ। তার মুখ, মাথা থেতলে এবং গলায় বিদ্যুৎতের তার পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে পুলিশ প্রাথমিক সুরতহালে আরও কিছু আলামত পায়। এই নারীকে ধর্ষণও করা হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে পুলিশের ধারণা হয় থার্টিফাস্ট রাতে আনন্দ উচ্ছ্বাসের নামে মাতাল হয়ে এই প্রতিবন্ধী নারীর উপর হয়তো পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে মাদকাসক্তরা। এ সময় তার পক্ষ থেকে বাধা পেয়ে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে ।
আর একজন রচনা আক্তার (ছদ্মনাম)। একজন মানবাধিকার কর্মী। মাদক ব্যবসায়ীদের মাদক ব্যবসায় বাধা দেয়ায় গতবছরের ২৫শে ফেব্রুয়ারি মাদক ব্যবসায়ীরা তাকে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের পর দু’জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। মামলার অন্যতম আসামি ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রকাশ্য দিবালোকে। মামলা তুলে নেয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে রচনা আক্তারকে। মামলা করে রচনা এখন নিরুপায়। জীবনের ভয়ে তিনি এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। শুধু তাই নয়, লম্পট ধর্ষকরা ধর্ষণের দৃশ্য ভিডিও করে। লোকলজ্জার ভয়ে রচনা এখন বোরকা পরে ঘুরে বেড়ান।
চৌদ্দ বছরের মেয়ে রূপালী (ছদ্মনাম) একজন জামদানি শিল্পী। সংসারের বোঝা টানতে প্রতিদিন তাকে ছুটতে হয়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে কাজ। কাজ শেষে বাসায় ফিরে। গত বছরের ২৬শে জানুয়ারি কাজ শেষে বাসায় ফিরে খাওয়া-ধাওয়া শেষ করে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ঘর থেকে বের হয়। এ সময় আগে থেকেই ওঁৎপেতে থাকা ৪ লম্পট তাকে তুলে নিয়ে পরিত্যক্ত একটি বাড়িতে তাকে ধর্ষণ করে।
আরও একজন স্মৃতি রানী দাস। গরিব পিতার সুন্দরী মেয়ে। তাই বখাটেদের নজরে আসে সহজেই। তাদের কুদৃষ্টি থেকে রক্ষা করতে অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেন বাবা, মা। তাও শেষ রক্ষা হয়নি। বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসে ৭ নরপশুর গণধর্ষণের শিকার হয় স্মৃতি। পরে অভিমানে ক্ষোভে আত্মহত্যা করে সে। রূপগঞ্জে আশঙ্কাজনকভাবে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেছে। গত ৫ বছরে এ উপজেলায় প্রায় একশ’র উপরে নারী, শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে অধিকাংশই গার্মেন্টকর্মী। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৫ নারী। আর ধর্ষণের বিচার হয়েছে মাত্র ৫ টির। অনুসন্ধানে মিলেছে এমন সব তথ্য।
রূপগঞ্জ থানা, উপজেলা মহিলা অধিদপ্তর ও বিভিন্ন সূত্রের প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১০ সালে ১৬টি। এর পরের বছর ২০১১ সালে ২৫টি। ২০১২ সালে ১৩টি। এরপর ২০১৩ সালে ১৬টি। ২০১৪ সালে ১৬টি। গত বছর ২২টি আর চলতি মাসে একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে ২টি, ফেব্রুয়ারিতে ১টি, মার্চে ২টি, মে মাসে ১টি, জুনে ২টি, জুলাই মাসে ৩টি, আগস্ট মাসে ৫টি আর সেপ্টেম্বর মাসে ৪টি। অক্টোবরে ১টি ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে । ধর্ষণের পর মোট ৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে। আর এ পর্যন্ত মাত্র ৫টি ঘটনার বিচার হয়েছে। অনেকে এখনো বিচার আশায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ বিচারের আশা ছেড়ে দিয়ে এলাকায় ফিরে গেছে। আবার অনেক ধর্ষণের ঘটনা থানা পর্যন্ত গড়ায়নি। স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বার ও মাতব্বররা বিচার-সালিশে নিষ্পত্তি করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১০ সালের মার্চ মাসে খাদুন এলাকায় নুরুন্নাহারকে ধর্ষণের পর হত্যা করে। নভেম্বর মাসে মৈকুলি এলাকায় গার্মেন্টকর্মী, একই মাসে বিরাব এলাকার কোহিনূর বেগম, ডিসেম্বর মাসে হোড়গাঁও এলাকার সাত বছরের শিশু উম্মেহানি, ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হারারবাড়ী এলাকার গৃহবধূ রীনা বেগম, মে মাসে টেকনোর্দা এলাকায় আড়াই বছরের শিশু, মে মাসে কাঞ্চন কুশাব এলাকার রোকেয়া বেগম, ২০১২ সালের জুলাই মাসে চনপাড়া এলাকায় দুই যুবতী সোনিয়া ও শিলা আক্তার, এপ্রিল মাসে হারভেস্ট রিচ গার্মেন্টের সামনে তামান্না নামে এক গার্মেন্টকর্মী, মার্চ মাসে নিউ ঢাকা এলাকায় রাজিয়া নামে এক গার্মেন্টকর্মী ধর্ষণের শিকার হয়। ২০১৩ সালে বরপা এলাকায় এক বাস ড্রাইভারের মেয়েকে ধর্ষণ করে তার ভিডিও ধারণ করে লম্পট প্রেমিক। একই বছর টানমুশুরী এলাকায় গণধর্ষণের শিকার স্মৃতি রানী আত্মহত্যা করে। ২০১৪ সালে মার্চ মাসে গোলাকান্দাইল নতুন বাজার এলাকায় একটি স্টুডিওর ভিতরে এক পোশাক শ্রমিককে ধর্ষণ করে স্টুডিও মালিক। ২০১৫ সালে ২৫শে জানুয়ারি মৈকুলি এলাকায় এক জামদানি শিল্পী, ১২ জানুয়ারি লিথুন গার্মেন্টের শ্রমিক, গত ২৭শে ফেব্রুয়ারি বরপা এলাকায় এক মানবাধিকার কর্মী, ২৫শে জুলাই মৈকুলি এলাকায় কিশোরী, গত ৩রা আগস্ট গোলাকান্দাইল নীলভিটা এলাকায় গণধর্ষণের শিকার হয় গার্মেন্টকর্মী, ৯ই আগস্ট রূপসী কাজীপাড়া এলাকায় গৃহবধূ, একই তারিখে পবনকূল এলাকায় কিশোরী, ১৯শে আগস্ট নবারুণ জুট মিলের পাশে এক শিশু, ২৫শে আগস্ট তারাব বিশ্বরোডে গার্মেন্টকর্মী, পহেলা সেপ্টেম্বর বাড়িয়াছনি এলাকায় কিশোরী, ১৬ই সেপ্টেম্বর বিরাব এলাকায় কিশোরী, ২৩শে সেপ্টেম্বর মোগরাকূল এলাকায় গার্মেন্টকর্মী, গত ২৬শে সেপ্টেম্বর নবারুণ জুট মিলের সিবিএ নেতার ছেলে মিঠু মিয়া কালাদী এলাকার কিশোরীকে অপহরণ করে তুলে নিয়ে গোলাকান্দাইল এলাকার একটি বালুর মাঠে ধর্ষণ করে। ৩০শে সেপ্টেম্বর সকালে পাচাইখা এলাকার অষ্টম শ্রেণির স্কুল শিক্ষার্থীকে অপহরণ করে তুলে নিয়ে এক লম্পট ধর্ষণ করেছে। নভেম্বর মাসে কাঞ্চন এলাকায় ভাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে এসে তালুই কর্তৃক ধর্ষনের শিকার হয় ৭ বছরের এক শিশু। সর্বশেষ চলতি বছরের পহেলা জানুয়ারি মাঝিনা এলাকায় মানসিক প্রতিবন্ধী নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে মাদকাসক্তরা।
সেলফোনে কথা হয় ধর্ষণের শিকার মানবাধিকার কর্মী রচনার (ছদ্মনাম) সঙ্গে। তিনি অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গেই বলেন, ধর্ষণের যদি ঠিকমতো বিচার হতো তাহলে এতো ঘটনা ঘটতো না। মাদক বিক্রির প্রতিবাদ করায় মাদক ব্যবসায়ীরা আমাকে নির্যাতন করেছে। এদের মধ্যে দুইজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও প্রধান আসামি ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে উল্টা মামলা তুলে নেয়ার জন্য আমাকে হুমকি দিচ্ছে। কথা হয় এক ধর্ষিতার মায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, বাবা আমার মাইয়ারে যেরা খারাপ কাম করছে হেরা মাইরা ফালানের হুমকি দিতাছে। তারা কয় কেস না তুললে এলাকা ছাড়া করবো। আমরা অহন ওগো ডরে এলাকার বাইরে থাহি। রূপগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ শাজাহান ভূঁইয়া বলেন, নারীদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দরকার। বাড়ানো দরকার সচেতনতা। যতোক্ষণ নারীরা নিজেদের আত্মরক্ষা নিজেরা না করতে পারবে ততোক্ষণ পর্যন্ত তারা নিরাপত্তার অভাব বোধ করবে। মনোবল অনেক ক্ষেতে বড় সহায়কের ভূমিকা পালন করে। নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান দিপু বলেন, নারী নির্যাতনের আইন শক্ত। কিন্তু মামলা হলে এজাহার দুর্বল থাকে। যার কারণে আসামীরা আইনের ফাঁক-ফোকড় দিয়ে বেরিয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, পর্যায়ক্রমে ধর্ষণের হার বেড়ে যাওয়ায় নেপথ্যে আকাশ সংস্কৃতি ও পর্নোগ্রাফির অবাধ ছড়াছড়ি। উপজেলা নারীনেত্রী রায়হানা সুলতানা কণা বলেন, রূপগঞ্জে নারী নির্যাতন মারাত্মক হারে বেড়েছে। ধর্ষণ, প্রেমের ফাঁদে ফেলে হয়রানির ঘটনা ঘটছে অহরহ। হিন্দি সিরিয়ালের প্রভাবও অনেকটা দায়ী নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে। উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা রোমানা আক্তার বলেন, রূপগঞ্জে মাদকের ব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে। এটা বন্ধ না হলে নারী নির্যাতন আরও বেশি হবে। ধর্ষণের প্রধান কারণ মাদক। কারণ যতটুকু শুনেছি মাদক সেবন করলে নাকি ভিতরে পশুত্ব জেগে ওঠে। আমরা প্রকল্পের মাধ্যমে চেষ্টা করছি উঠান বৈঠক করে মানুষকে সচেতন করতে। তিনি আরও বলেন, চক্ষুলজ্জার ভয়ে অনেকে ধর্ষণের কথা গোপন রাখে অথবা স্থানীয় চেয়ারম্যানদের কাছে যায়। চেয়ারম্যানরা যদি ধর্ষকদের শক্ত হাতে শায়েস্তা করে পুলিশে দিতেন তাহলেও কিছুটা কমে আসতো। রূপগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মাহমুদুল ইসলাম বলেন, রূপগঞ্জ হচ্ছে শিল্পাঞ্চল এলাকা। পাশাপাশি বহিরাগত লোকজনদের আনাগোনা বেশি। এছাড়া এলাকাবাসীর সামাজিক মূল্যবোধ কম। তাই নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। সেমিনার, সভা-সমাবেশ করে মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করে যাচ্ছি। তবে পুলিশের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। আমার সময় কোন ধর্ষণের ঘটনায় কোন অপরাধী ছাড় পায়নি। এসব ব্যাপারে বরাবর আমার শক্ত অবস্থান ছিল। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. লোকমান হোসেন বলেন, নারী নির্যাতন বন্ধে সচেতনতামূলক কার্যক্রম করছি। রূপগঞ্জে নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের কারণ বহিরাগত ও গার্মেন্ট শিল্প বেশি। অনেকে ঘটনা ঘটিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যায়।