‘মেয়েটি মারা যাচ্ছিল, তা দেখেও শ্রমিকরা গালিগালাজ করতে থাকে’
বড়লেখা (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি : পরিবহন শ্রমিক ধর্মঘটের সময় মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার চান্দগ্রামে অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখায় মারা যাওয়া সাতদিনের কন্যাশিশুর বাড়িতে এখন শোকের মাতম চলছে। এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া। এই মৃত্যুকে সহজভাবে কেউ মেনে নিতে পারছেন না। শিশুটির পরিবারকে শান্তনা দিতে ছুটে আসছেন অনেকেই।
গত রোববার বড়লেখা থেকে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বড়লেখা উপজেলার বড়লেখা সদর ইউনিয়নের অজমির গ্রামের বাসিন্দা প্রবাসী কুটন মিয়ার সাতদিনের কন্যাশিশুকে নিয়ে যাওয়ার সময় পরিবহন শ্রমিকরা চান্দগ্রামে প্রায় দেড় ঘণ্টা অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখে। এতে চান্দগ্রামে অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যেই শিশুটি মারা গেছে।
গতকাল সোমবার দুপুরে সরেজমিনে গেলে দেখা গেছে, কন্যা শিশুর মৃত্যুতে অজমির গ্রামে তাদের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া। শোকাহত মা বাবাকে শান্তনা দিতে বাড়িতে ভীড় করছেন স্বজন ও এলাকার লোকজন। শ্রমিক ধর্মঘটের বলি হওয়া এই শিশুর করুণ মৃত্যুতে ঘৃণা জানাচ্ছেন লোকজন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতারা বাড়িতে গিয়ে শিশু কন্যার মা ও বাবাকে শান্তনা দিতে দেখা গেছে। শিশু কন্যার মা-বাবাকে শান্তনা দিতে বাড়িতে যাওয়া সকলের একটি কথা ঘটনার সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিটা যেন হয়।
শিশু কন্যার মা সায়রা বেগম বলেন, ‘এই ঘটনার উপযুক্ত বিচার চাই। তারারে কইছি আমার বাচ্চাটা অসুস্থ। কিন্তু কেউ আমার কথা শুনেনি। আমি দেখিয়ার আমার বাচ্চাটা মারা যার। তারারে কইরাম হখলর বইন ভাগ্নি দিছইন রেবা। আমার বাচ্চাটার কষ্ট অর। ছাড়ি দেও। তারা উল্টা কইন কিসের রোগী। তোমরা বিয়াত যাইরায়। একেকজন শ্রমিক একেক কথা বলে। ধমক দেয়। ড্রাইবাররে কইছি আমাকে নামাইয়া দেও। আমার শরীর কিতা করের। আমি হাটিয়া যাইমু গিয়া। আমার চোখের সামনে মেয়েটা ওখানেই মারা গেছে।’
শিশু কন্যার পিতা কুটন মিয়া বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্সে নেওয়ার পথে পুরাতন বড়লেখা বাজারে ড্রাইবারের কাগজপত্র। আমার বাচ্চার কাগজপত্র চেক করছে। এত রিকোয়েস্ট করছি। ছাড়ছে না। আধা ঘণ্টা পরে ছাড়ছে। ইকান থাকি দাসের বাজার গিয়ে আটকা পড়ি। তারা গাড়ি ব্যারিকেড দেয়। এখানেও কাগজপত্র দেখে ছাড়েনি। অনেক উত্তেজনা করেছে। গাড়ি থেকে ড্রাইবার টানিয়া নামাইছে। মারধর করেছে। অনেক অনুরোধ করেছি। ছাড়েনি। তাদের ইচ্ছামত পরে ছাড়ছে। চান্দগ্রাম যাওয়ার পরে আবার আটকাইছে। অনেক অনুরোধ করলাম। এখানেও ছাড়েনি। দেড় ঘণ্টার মতো রাখছে। খুব অনুরোধ করার পর ৫০০ টাকা দাবি করছে। তখন আমি আমার পকেট থেকে ৫০০ টাকা বের করি। তারা বলে তুমি দিলে হবে না। ড্রাইবার দিতে হবে। এরই মাঝে আমার মেয়েটা মারা যায়। এরপর যখন তারা গাড়িতে এসে দেখেছে বাচ্চা মারা গেছে। তখন তারা গাড়িসহ বাচ্চা ছাড়ছে। আমি এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাইরাম। কিসের জন্য রাস্তা অবরোধ করে আমার বাচ্চাটা মারলো। প্রশাসনের কাছে সুষ্ঠু বিচার চাই।’
অ্যাম্বুলেন্স চালক শিপন আহমদ বলেন, ‘আমি হাসপাতাল থেকে টিপ (ট্রিপ) নিয়ে পুরাতন বড়লেখা যাই। পুরাতন বড়লেখা বাজারে ৫ থেকে ৬ জন আটকায়। তারা যাইতে দেয় না। তারা বলেছে বিয়ার অনুষ্ঠানে যাইরায়। এর লাগি নাটক সাজাইয়া যাইরায়। কাগজপত্র দেখাইছি। তারপর ছাড়ছে। এরপর দাসের বাজার আটকাইছে। দাসের বাজারে খুব বেশি ডিস্টার্ব দিছে। আধা ঘণ্টার মতো। আমার কলার ধরে টানাটানি করেছে। কাগজপত্র দেখতে চাইছে। কাগজপত্র দেখাইছি। বাচ্চার ছাড়াপত্রও দেখাইছি। তাও ছাড়ের না। পরে জোরেজারে ছুটছি। পরে চান্দগ্রাম গেলে সেখানেও আটকায়। সেখানে বাচ্চার বাবার কাছে একজন ৫০০ টাকা দাবি করে। বলেছে ৫০০ টাকা দিয়ে গাড়ি নিয়ে যাও। তারা চাঁদা দাবি করেছে। তাদের দেখলে চিনব। এদের মাঝে কিছু সিএনজি ড্রাইবারও আছেন।’
শিশু কন্যার গ্রামের বাসিন্দা আলী হোসেন বলেন, ‘আমরা গভীরভাবে শোকাহত। নিন্দা জানানোর কোনো ভাষা নেই। এদের কি কোনো বিবেক নেই। একটা বাচ্চা মারা যাচ্ছে। গাড়িটি ছাড়েনি। উল্টো উপহাস করেছে ওর মা-বাবাকে নিয়ে। এটা কোন ধরনের আন্দোলন। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।’ একই রকম কথা বলেছেন, গ্রামের ইয়াছিন আলী ও নজরুল ইসলাম।
বড়লেখা সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সোয়েব আহমদ বলেন, ‘শ্রমিক আন্দোলনের নামে একটা ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটানো হয়েছে। তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। শিশুটির পরিবার আমার ইউনিয়নের বাসিন্দা। ঘটনার পর থেকে তাঁদের সার্বিক খোঁজ-খবর নিচ্ছি। শ্রমিক ধর্মঘটের নামে এই অযৌক্তিক আন্দোলন দ্রুত প্রত্যাহারের দাবি জানাই। পাশাপাশি সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে দ্রুত এ ধর্মঘটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহবান জানাই।’
বড়লেখা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. ইয়াছিন আলী বিকেল সাড়ে ৪টায় বলেন, ‘আমরা শিশুর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। বাড়িতে গিয়েছি। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ দেওয়া হয়নি। অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ কালের কণ্ঠ