নির্বাচনী বছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের হিড়িক
অনলাইন ডেস্ক : আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে, সারা দেশে মাধ্যমিক স্তরের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের হিড়িক পড়েছে। গত দুই মাসে সারা দেশের ৫৭টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের আদেশ জারি করা হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে। সর্বশেষ গত ২১ মে ২৪টি বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল জাতীয়করণের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এর আগে গত ৭ মে ১২টি প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হয়। তারও আগে ১১ এপ্রিল আরো ২১টি প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের সরকারি যে নীতিমালা রয়েছে, এ ক্ষেত্রে তা অনুসরণ করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় এবং সরকারদলীয় এমপির পছন্দ-অপছন্দ এতে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের শর্তপূরণ না করা প্রতিষ্ঠানও এ তালিকায় রয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে যেসব জেলা-উপজেলায় এসব প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হয়েছে, সেসব এলাকার যোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ, মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছে।
এ ছাড়া দেশের ৮টি শিক্ষা বোর্ডের অধীন মাধ্যমিক স্তরের ১৩০ বিদ্যালয়ে পাঠদানের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। গত ১৪ ও ১৫ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পৃথক আদেশে এ অনুমোদন দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রেও প্রতিটি বিদ্যালয়কে স্থানীয় এমপির বিশেষ অনুরোধ এবং ডিও লেটার নিতে হয়েছে। এমপিদের সুপারিশ ও ডিও লেটার না থাকায় যোগ্য ও শর্তপূরণ করা সত্ত্বেও শতাধিক প্রতিষ্ঠানের আবেদন গৃহীত হয়নি। নতুন করে স্কুল ও কলেজ অনুমোদনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও আগামী কিছু দিনের মধ্যে আরো দুই শতাধিক বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দিতে যাচ্ছে সরকার।
এ দিকে গত মাসে দুই দফায় চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেয়া হয়। আরো আধা ডজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের অপোয় রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। শীর্ষপর্যায়ের সবুজ সঙ্কেত পাওয়া মাত্রই এ ছয়টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের জন্য সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হবে। যেকোনো সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনুমোদন দেয়া হবে। এই ছয়টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের সবাই আওয়ামী ঘরানার এবং ক্ষমতাসীন দলের কোনো না কোনো প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপির নিকটজন অথবা তারা নিজেরাই এর সাথে সংযুক্ত বলে জানা গেছে।
শিাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের শিাব্যবস্থায় যে নৈরাজ্য চলছে তার অন্যতম কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনুমোদন, নিয়োগ, ব্যবস্থাপনা-পরিচালনার সাথে সম্পৃক্তরা সবাই কোনো না কোনো পর্যায়ে ক্ষমতাসীনদের সাথে যুক্ত। ফলে কোথাও জবাবদিহিতা বা স্বচ্ছতার বালাই নেই। মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যেই শিাপ্রতিষ্ঠান করা হচ্ছে। এতে মানসম্মত শিা দুরূহ হয়ে পড়েছে।
আরও : ইস্ট লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসে স্পিকার হলেন আয়াছ মিয়া
গত ৯ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের দুই মেয়াদে ৪৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বর্তমানে সারা দেশে ১০১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম (শিক্ষা কার্যক্রম) চলছে ৯৫টিতে। ৪৭টির মধ্যে ২০১২ সালে ১৬, ২০১৩ সালে ১০, ২০১৪ সালে ২, ২০১৫ সালে ৩, ২০১৬ সালে ৬, ২০১৭ সালে ৫ এবং চলতি ২০১৮ সালে এ পর্যন্ত ৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পেয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় উদ্যোক্তাদের মধ্যে আছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও এমপি ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও এমপি নজরুল ইসলাম বাবু, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এনামুল হক শামীম, এ এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী, সিলেটের গোলাপগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা ইকবাল আহমেদ চৌধুরী, সরকারদলীয় এমপি সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার, আওয়ামী লীগ উপদেষ্টাম লীর সাবেক সদস্য দুর্গাদাস ভট্টাচার্য, ব্যবসায়ী জয়নুল হক সিকদার, সাবেক আইনমন্ত্রী এবং এমপি আবদুল মতিন খসরু, খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও নবনির্বাচিত মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উ শৈ সিং, বি এম শামসুল হক, কাজী রফিকুল আলম, ড. এম জুবায়েদুর রহমানসহ কয়েকজন নেতা ও ব্যবসায়ী। এ ছাড়াও পুরনো একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত সিকদারসহ কয়েকজন যুক্ত হয়েছেন।
জানা গেছে, দেশে নতুন করে কোনো স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এসব অনুমোদন বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু সম্প্রতি সরকারের প্রভাবশালী কয়েকজন মন্ত্রী ও এমপির চাপে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পেতে যাচ্ছে নতুন স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়। এবারের এসএসসিতে ১২২টি শিা প্রতিষ্ঠানের একজন শিার্থীও পাস করতে পারেনি। এর মধ্যে আটটি সাধারণ শিা বোর্ডের অধীন এসএসসিতে ১৬টি স্কুল ও মাদরাসা বোর্ডের অধীন দাখিল পরীায় ৯৬টি মাদরাসা রয়েছে। দেখা গেছে, এসব শিা প্রতিষ্ঠানে প্রতি বছর সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে। মাগুরার রিজিয়া রুবিয়া মহিলা দাখিল মাদরাসার ২০ জন ছাত্রী দাখিল পরীক্ষা দিয়ে সবাই ফেল করায় এলাকাবাসী ােভ প্রকাশ করেন। এমপিওভুক্ত এ প্রতিষ্ঠানটিতে ১৪ জন শিক ও তিনজন কর্মচারী রয়েছেন।
শিা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি বেসরকারি শিাপ্রতিষ্ঠানের অনুমতি, অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতি, অতিরিক্ত শ্রেণী, নতুন বিষয়-বিভাগ খোলা সংক্রান্ত কমিটির সভা হয়। কমিটির আহ্বায়ক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক-২) জাবেদ আহমেদের সভাপতিত্বে ওই সভায় ৪৯৬টি স্কুল ও কলেজে পাঠদানের অনুমতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তার মধ্য থেকে গত ১৪ ও ১৫ মে ১৩০টি অনুমোদন দেয়া হয়।
কাম্য জনসংখ্যা ও প্রাপ্যতা না থাকার পরও নতুন করে যে ২০০ স্কুল ও কলেজ অনুমোদন দেয়ার তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে, সেগুলোর জন্য মন্ত্রী, এমপি, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা ও আমলার সুপারিশ- তদ্বির রয়েছে বলে জানা গেছে।। তারা শিা মন্ত্রণালয়কে চাপ দিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, নতুন অনুমোদন দিতে ২০০ স্কুল ও কলেজের তালিকা করা হয়েছে। শিগগিরই এসব প্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেয়া হবে।
১৯৯৭ সালের বেসরকারি শিাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও স্বীকৃতি নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতি আট হাজার জনসংখ্যার জন্য একটি নিম্নমাধ্যমিক স্তরের (ষষ্ঠ-অষ্টম), ১০ হাজার জনসংখ্যার জন্য একটি মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (স্কুল বা মাদরাসা) এবং ৭৫ হাজার জনসংখ্যার জন্য উচ্চমাধ্যমিক স্তরের (কলেজ-আলিম মাদরাসা) প্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেয়া যাবে। দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্বের শর্তে বলা হয়েছে, নিম্নমাধ্যমিকের ক্ষেত্রে পৌর এলাকায় এক কিলোমিটার ও মফস্বল এলাকায় ছয় কিলোমিটার। মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে মফস্বল এলাকায় চার কিলোমিটার আর উচ্চমাধ্যমিকের ক্ষেত্রে পৌর এলাকায় দুই কিলোমিটার আর মফস্বল এলাকায় ছয় কিলোমিটার হতে হবে।