গ্রীষ্মকালে মুমিনের আমল
বাংলার ঋতু থেকে চির সৌন্দর্যের আধার বসন্ত বিদায় নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড তাপদাহে চৌচির হয়ে পড়ে গ্রামের মেঠোপথ, মাঠঘাট। গরমের তীব্রতায় হাঁপিয়ে ওঠে পশুপাখি। দরদর করে ঘামতে থাকে মানুষ। বাইরে বেরোলেই জ্বলন্ত সূর্য থেকে মাথার ওপর ঝরে পড়ে আগুনের ফুলকি। লু-হাওয়ায় মনটা তখন বড্ডো উদাস বনে যায়। ভরদুপুরে গাছের শীতল ছায়ায় বসে গল্পে মাতেন গ্রামের বয়োবৃদ্ধরা। একফোঁটা পানির আশায় চাতক পাখির মতো মুখিয়ে থাকে ঝিমিয়ে পড়া প্রকৃতি। হঠাৎ পশ্চিমাকাশ কালো করে ঝাঁপিয়ে নামে বৃষ্টি। সেই সঙ্গে প্রচ- ঝড়। ছোট ছেলেমেয়েরা বৃষ্টিতে ভিজে কুড়ায় পাকা আম। রিমঝিম ছন্দের দ্যোতনায় মিলেয়ে যায় ওদের হৈ হুল্লোড় আর আনন্দ ধ্বনি। মন চায় তখন শৈশবে ফিরে যাই।
আল্লাহ তায়ালার অপার নেয়ামত বৃষ্টি গাছ আর লতাপাতায় সজীবতার প্রলেপ এঁকে যায়। জমিনে ফলায় ফসল। সবুজে ভরিয়ে দেয় প্রকৃতি। ফলফলাদির পাকা ঘ্রাণে ম-ম করে চারদিক। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুক, আমি তো অঝর ধারায় বৃষ্টি বর্ষণ করেছি। অতঃপর মাটিকে বিদীর্ণ করেছি। আর তাতে উৎপন্ন করেছি শস্যাদি, আঙুর, শাকসবজি, যয়তুন, খেজুর, ঘন উদ্যান, ফল-ফলাদি ও ঘাস। এসব তোমাদের ও তোমাদের পালিত পশুকুলের জীবনধারণের জন্যে’। (সুরা আবাছা: ২৪-৩২)
প্রচণ্ড গরমে ঘামের সঙ্গে শরীরের প্রয়োজনীয় যে ভিটামিন বের হয়ে যায়, তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে মহান আল্লাহ তায়ালা গ্রীষ্মকালে রেখেছেন নানা রঙের সুস্বাদু ফল। আম, জাম, তরমুজ, জামরুল, লিচু, কাঁঠাল আরো কতো কি! বান্দার উচিৎ আল্লাহ প্রদত্ত রিজিক আহার করে রিজিকের ব্যাপারে চিন্তাফিকির করা ও ঈমান মজবুত করা। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তাকে তিনি তার ধারণাতীত স্থান থেকে দান করবেন রিজিক।’ (সুরা তালাক: ৩)
গরম থেকে শিক্ষা:
গরমের তীব্রতা থেকে মুমিনের জন্যে রয়েছে শিক্ষা। কেননা, জাহান্নামের আগুনের উত্তাপ পৃথিবীর আগুনের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি। তাই এর থেকে জাহান্নমের প্রখরতা অনুমান করে গুনাহ থেকে মুক্ত থাকা উচিৎ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জাহান্নাম তার প্রতিপালকের কাছে এ বলে নালিশ করেছিল, হে আমার প্রতিপালক! (দহনের প্রচ-তায়) আমার এক অংশ আরেক অংশকে গ্রাস করে ফেলছে। ফলে আল্লাহ তাকে দুইটি শ্বাস ফেলার অনুমতি দেন। একটি শীতকালে অপরটি গ্রীষ্মকালে। আর তাই তোমরা গ্রীষ্মকালে প্রচ- উত্তাপ এবং শীতকালে যে প্রচ- ঠা-া অনুভব করো।’ (বোখারি: ৫৪৫৫)
গরমের সময় অল্প আমল করে অধিক সোওয়াব লাভের রয়েছে বেশ কিছু আমল রয়েছে। একজন মুমিন সে আমল করে সহজেই আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারে। আসুন আমলগুলো সম্পর্কে জেনে নেই।
নফল রোজা:
গরমের রোজা শীতের থেকে বেশি কষ্টকর। সে কষ্ট উপেক্ষা করে যদি নফল রোজা রাখা যায়, তাহলে আল্লাহ তায়ালা নেকীও দিবেন বেশি। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) অধিক সওয়াবের আশায় গরমকালে রোজা রাখতেন। তাছাড়া নভোম-ল ও ভূম-লের চিরাচরিত পরিবর্তনের ফলে পবিত্র রমজান মাস এখন গরমকালে পড়ছে। অধিক সোয়াব ও পরকালের ভয়কে সামনে রেখে সবার উচিৎ আবহাওয়া প্রচ- গরম হওয়া সত্ত্বেও ফরজ রোজাগুলো রাখা।
ছায়াদার বৃক্ষ নিধন থেকে বিরত থাকা:
গ্রীষ্মের গনগনে রোদে গাছের শীতল ছায়া সকলের প্রিয়। তাই ছায়াদার বৃক্ষ নিধন থেকে বিরত থাকা সবার কর্তব্য। তাই নবী করিম (সা.) একান্ত প্রয়োজন ছাড়া মানুষের চলাচলের পথে অবস্থিত ছায়াদার বৃক্ষ কাটতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। (আবু দাউদ) ছায়াদার বৃক্ষের নিচে তথা মানুষের বিশ্রামের স্থানে মূলমূত্র ত্যাগের ব্যাপারেও বিশেষ নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত হয়েছে।
পিপাসার্তকে পানি পান করানো:
পিপাসার্তকে পানি পান করানো একটি উত্তম কাজ। আর যদি প্রচ- গরমে কাউকে ঠা-া পানি পান করানো হয়, তাহলে তো কাজটি আরো উত্তম হবে। এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে প্রশ্ন করলেন, ‘কোন দান উত্তম? তিনি বললেন, ‘পানি পান করানো।’ (নাসাই: ৫৪৫৬) ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেন, ‘তৃষ্ণার্তের তৃষ্ণা নিবারণ সর্বোত্তম মহৎ কাজের একটি।’ অন্য একটি হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সদকা বা দান জাহান্নামের আগুন নির্বাপণ করে। আর পানি পান করানো উত্তম সদকা।’ (আবু দাউদ: ৭৪৩৫)
সুতরাং গ্রীষ্মকালে তৃষ্ণার্ত ব্যক্তিকে পানি পান করানো জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষার অন্যতম উপায়। বনি ইসরাইলের এক পাপিষ্ঠ নারী একটি পিপাসার্ত কুকুরকে পানি পান করিয়ে তার জীবন রক্ষার কারণে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। এছাড়াও গরিব-দুঃখীদের মাঝে সুমিষ্ট ফল বিতরণ করা, ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদেরকে সাহায্য করা, ঘর্মাক্ত শরীরে জনসমাগমে গমন না করা, গরমের সময় প্রবাহিত ঘামের গন্ধ যেন অন্যের কষ্টের কারণ না হয়, গ্রীষ্মকালকে গালমন্দ না করা সেদিকে খেয়াল রাখার নির্দেশ করেছে ইসলাম।