রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ‘আদর্শ বৌদ্ধ গ্রাম’ নির্মাণ করছে মিয়ানমার
ঘর ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হওয়া রোহিঙ্গাদের রাখাইনে বৌদ্ধ মডেল গ্রাম গড়ে তুলছে মিয়ানমার। বুলডোজার চালিয়ে সেখানে ধ্বংস করা হয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধের আলামত। স্থানে স্থানে স্থাপিত হচ্ছে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট। মিয়ানমারের দাবি, চলমান প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে যেসব রোহিঙ্গা রাখাইনে ফিরবেন, তাদের জন্যই পুড়ে যাওয়া গ্রামগুলোতে সংস্কার প্রক্রিয়া চলছে। অথচ ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি’র শুক্রবারের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বুলডোজারে রোহিঙ্গা স্মৃতি মুছে দিয়ে বিপুল সামরিকায়িত রাখাইনে এখন বৌদ্ধ মডেল গ্রাম নির্মাণ করা হচ্ছে। ওই প্রতিবেদনে অনুযায়ী, সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে, রাখাইন-বৌদ্ধদের অর্থায়ানে পরিচালিত সংস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে রোহিঙ্গাশূন্য রাখাইন গড়ে তোলার প্রকল্প।
গত বছরের ২৫ আগস্ট নিরাপত্তা চৌকিতে আরসার হামলাকে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের কারণ বলা হলেও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিতে এবং তাদের ফেরার সমস্ত পথ বন্ধ করতে আরসার হামলার আগে থেকেই পরিকল্পিত সেনা-অভিযান শুরু হয়েছিল। চলমান জাতিগত নিধনে হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭ লাখ মানুষ। তারা কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পালিয়ে আসা বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পন্ন হলেও তা কার্যকরের বিষয়টি এখনও প্রক্রিয়াধীন। কেবল গত বছর আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ৭ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এলেও এখন পর্যন্ত কেবল ৩৮৮ জনকে ফেরত নেওয়ার প্রক্রিয়া চালু রাখার কথা জানিয়েছে মিয়ানমার। এই অবস্থাতেই গ্রামগুলোতে বুলডোজার চালিয়ে আলামত নষ্ট, বিপুল সামরিকায়ন, উন্নয়ন প্রকল্প চলমান থাকা এবং প্রত্যাবাসন নিয়ে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর হুমকির তথ্য পাওয়া যায়। তারই ধারাবাহিকতায় বৌদ্ধদের মডেল গ্রাম গড়ে উঠছে বলে খবর পাওয়া গেল।
এএফপির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে রাখাইন বৌদ্ধদের জন্য স্থাপিত ‘আদর্শ বৌদ্ধ গ্রাম’ কোয়ে তান কাউক এর কথা। কদিন আগেই এটি ছিল রোহিঙ্গা আবাস। এক সময় রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাটি এখন উত্তর দিকে সরে রাখাইন অভিবাসীদের দখলে। গ্রামের প্রবেশ পথে বাঁশের মাথায় উড়ছে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতীক আঁকা পতাকা। বুলডোজার চালিয়ে গ্রাম আর বেড়ে ওঠা কৃষিক্ষেত মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোহিঙ্গা বসতির চিহ্ন পরিস্কার করে ফেলে নতুন আগতরা এখানে বসতি গড়েছেন। গরিব হলেও তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল দক্ষিণ রাখাইনের অভিবাসীরা সংখ্যায় বেশ অল্প। কোয়ে তান কাউকের সাধারণ কুঁড়ে ঘরে স্বামী সন্তান নিয়ে ওঠা ২৮ বছর বয়সী চিত সান ইয়েইন রোহিঙ্গাদের বোঝাতে অপমানজনক সম্বোধন করে এএফপিকে বলেছেন, ‘আমার সত্যিই ওই ‘কালারদের’ (রোহিঙ্গাদের এই নামেই সম্বোধন করে স্থানীয়রা) ভয় পাই এবং এখানে আসতে চাই না। কিন্তু এখন, তারা আর সেখানে নেই। তাই আমরা সুযোগ পেয়েছি এখানে বসবাসকারী আমাদের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে আবারও মিলিত হওয়ার।’
এএফপি বলছে, পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ভূমির দখল নেওয়া রাখাইনের একটি পুরনো কৌশল। মিয়ানমার একে অনধিকারপ্রবেশকারী ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের একটি লড়াই হিসেবে দেখে থাকে। দক্ষিণ ও কেন্দ্রীয় রাখাইন থেকে তাড়ানো হয়েছে ৩ লাখ রোহিঙ্গাকে। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এক প্রতিবেদনে জানায়, নিধনযজ্ঞের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা পালিয়ে যাওয়ার পর তাদের ফেলে আসা গ্রাম ও জমিজমায় ঘাঁটি তৈরি করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এখনও ধ্বংস না হওয়া ঘরবাড়ি নতুন করে জ্বালিয়ে দেওয়ারও আলামত মিলেছে। এক বিবৃতিতে সে সময় সংস্থাটির সংকট মোকাবেলাবিষয়ক পরিচালক তিরানা হাসান অন্তত ৩টি সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ চলমান থাকার কথা জানিয়েছিলেন। একই সঙ্গে স্থাপনা ও রাস্তাঘাট নির্মাণের কাজ চলার ক্থাও জানা গিয়েছিল তখন।
ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর বরাত দিয়ে সামরিক সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট সোফরেপও একই অভিযোগ করেছিল। এর আগে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের অন্তত অর্ধ শতাধিক গ্রাম বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রমাণ হাজির করে মার্কিন মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এইচআরডব্লিউ, যুক্তরাজ্যরাজ্যভিত্তিক অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং মিয়ানমারের স্থানীয় একটি মানবাধিকার সংস্থা। তারা বলেছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সামরিক বাহিনীর নিধনযজ্ঞ আড়াল করতেই গ্রামগুলোতে বুলডোজার চালানো হচ্ছে।
‘মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ শত্রু: বৌদ্ধ সহিংসতা ও মুসলিমদের অপর বানানো’ শীর্ষক বইয়ের রচয়িতা ফ্রান্সিস ওয়েড এএফপিকে বলেন, উত্তর রাখাইনের সামাজিক ভূচিত্রের মধ্যে কৌশলে বিভক্তি ছড়িয়েছে সামরিক বাহিনী। আর তা করতে গিয়ে ১৯৯০ এর দশকের শুরু থেকেই সেখানে রোহিঙ্গা জনবসতি পাতলা হতে শুরু করে। তিনি বলেন, মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়টির নাগরিকত্ব অস্বীকার করে তাদের বাঙালি তকমা দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে তাদের কথিত উৎসভূমিতে ফেরত পাঠানোর যুক্তি দাঁড় করানো হয়। একই আদলে ইসরায়েল পশ্চিম তীরে দখলদারি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বৌদ্ধ সম্প্রদায় এখানে আসার ফলে কার্যত মুসলিমদের ভূমির অধিকার পর্যায়ক্রমে মুছে যাচ্ছে। ফ্রান্সিস ওয়েড বলেন, আগামী বছরগুলোতে আরও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর আবাস এখানে দেখতে পাবো। আর তখন আমরা ভুলে যাবো একসময় এই এলাকা আসলে কি ছিল। আর এই প্রক্রিয়াতেই রোহিঙ্গাদের চিহ্ন মুছে ফেলার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
বিদ্বেষী প্রচারণার মধ্য দিয়ে রাখাইনের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সেখানকার রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ ঘৃণার চাষাবাদ করেছে দীর্ঘদিন। বিদ্বেষের শেকড় তাই দিনকে দিন আরও শক্ত হয়েছে। মিয়ানমারের অধিবাসী হলেও রোহিঙ্গাদেরকে বেশিরভাগ রাখাইন বৌদ্ধ বাংলাদেশ থেকে সেখানে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী বিবেচনা করে। সরকারের সঙ্গের বৈঠকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব ও অন্যান্য অধিকারের দাবির পেছনে রাখাইনের ভূমি দখলের অন্য রাজনৈতিক এজেন্ডা থাকার অজুহাত তোলেন জাও উইন। দাবি করেন, জাতিগত রাখাইনদের নিরাপত্তা ও রোহিঙ্গাদের রাখাইনের ভূমি দখলের রাজনৈতিক এজেন্ডায় মিয়ানমার শঙ্কিত। সেখানে তাই রাখাইন বৌদ্ধদের অর্থায়নে এবং সেনা মদদে বেসরকারী প্রকল্প পরিচালনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাশূন্য রাখাইন গড়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে।
সিআরআর নামে পরিচিত ‘অ্যান্সিলারি কমিটি ফর দ্যা রিকন্সট্রাকশন অফ রাখাইন ন্যাশনাল টেরিটোরি ইন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার’ তেমনই এক প্রকল্প। প্রকল্পটি রাখাইন নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের টাকায় চলছে।এএফপি বলছে, সেনাবাহিনীর মদদ ছাড়া এমন প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
‘অ্যান্সিলারি কমিটি ফর দ্যা রিকন্সট্রাকশন অফ রাখাইন ন্যাশনাল টেরিটোরি ইন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার’ প্রকল্পের উপদেষ্টাদের একজন রাখাইনের আইনপ্রণেতা উ হ্লা সঅ বলেছেন, সিআরআরের উদ্দেশ্য, রাজ্যের রাজধানী সিতউয়ে থেকে শুরু করে মংডু শহর পর্যন্ত প্রায় ১০০ কিলোমিটার দৈর্ঘের একটি রোহিঙ্গাশূণ্য ‘বাফার জোন’ প্রতিষ্ঠা করা। এএফপিকে তিনি বলেছেন, ‘এই পুরো এলাকা রোহিঙ্গাদের প্রভাবাধীন ছিল। সেনাবাহিনীর অভিযানের পর তাদেরকে পালাতে হয়েছে…তাই এই এলাকায় আমরা রাখাইন বসতি স্থাপন করছি।’ তার ভাষ্য, ‘এলাকাটি যেন গড়ে উঠতে পারে’ সেজন্য সিআরআর বাসস্থান নির্মাণ ও কর্মসংস্থানে অর্থের যোগান দেবে।
সিআরআরের স্থানান্তরিত ৬৪টি পরিবার ও প্রায় ২৫০ জনকে নিয়ে এখন পর্যন্ত বসতির খুব সামান্যই গড়ে উঠেছে, যদিও অপেক্ষা তালিকায় রয়েছে প্রায় ২০০ পরিবার। দক্ষিণে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরের থান্ডউয়ে থেকে যাওয়া দরিদ্রদের মধ্যেও বেশি দরিদ্র এসব মানুষগুলো পেশায় মূলত দিনমজুর অথবা সিতউয়ে থেকে যাওয়া পশুপালনকারী। রাথিডংয়ের কাছে কোয়ে তান কাউক এবং মঙডুর কাছে ইন ডিন নামের দুটো গ্রাম এখন পর্যন্ত প্রস্তুত করা হয়েছে সিআরআরের প্রকল্পের অধীনে। দ্বিতীয় স্থানটি হচ্ছে সেই স্থান যেখানে গত আগস্টে সহিংসতা শুরুর পর আটক রোহিঙ্গাদের হত্যা করে প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে স্বীকার করতে বাধ্য হয় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। কোয়ে তান কাউকেও রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের যৌথ বসতি ছিল। সিআরআরের অর্থায়নে হওয়া এই বসতি খুবই অপরিকল্পিত।