মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উপর জরিপে জানা গেছে, ২৮ হাজার তিনশ’ রাহিঙ্গা শিশু কমপক্ষে একজন অভিভাবক হারিয়েছে। অন্যদিকে ৭,৭০০ শিশু তারা তাদের পিতামাতা দু’জনকেই হারিয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আসিয়ান পার্লামেন্টারিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস (এপিএইচআর) জানিয়েছে, নিখোঁজ পিতামাতার সংখ্যা হবে ৪৩, ৭০০ এর মতো। তবে এটা এখনো নির্ধারণ হয়নি শিশুদের মধ্যে কতজন ভাই-বোন।
এপিএইচআর’র গবেষণা এবং প্রচার বিভাগের পরিচালক সেমেট টাইম’কে জানান, এই সংখ্যা সেসব রোহিঙ্গা শিশুদেরই যাদের পিতামাতা সঙ্গে নেই; কারণ তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে। অথবা তারা কোথায় রয়েছেন তার সন্ধান নেই। এই পর্যন্ত কতজনকে হত্যা করা হয়েছে সে ব্যাপারে কোন বিশ্বাসযোগ্য তথ্য নেই। জাতিসংঘ যাকে ‘জাতিগোষ্ঠি নিধন’ কর্মসূচি বলে আখ্যায়িত করেছে। ‘ডক্টরস উইদআউট বর্ডারের’ হিসাবে সহিংসতার প্রথম মাসেই ৬৭০০ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে।
ফোর্টিফাই রাইটস’র ম্যাথিও স্মিথ বলেন, চলমান নিষ্ঠুরতার মাত্রার আসল চেহারা উন্মোচন হতে শুরু করেছে নিখোঁজ পিতামাতার সংখ্যার মাধ্যমে। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় বাহিনী যেসব এলাকায় নিষ্ঠুরতা চালিয়েছে তার প্রত্যক্ষদর্শী ও যারা পালিয়ে এসেছে তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য দেওয়া হয়েছে। হতে পারে নিখোঁজ পিতামাতার উল্লেখযোগ্য একটি অংশকে হত্যা করা হয়েছে। ২০১৬ সালে এবং গত আগস্টে যে তিনটি শহরতলী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেখানে নির্বিচারে হত্যা এবং গণহত্যা চালানো হয়েছে।
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস ফেব্রুয়ারি মাসে সহিংসতার কেন্দ্র গু দার পিইয়িনের কাছে একইস্থানে কমপক্ষে পাঁচটি গণকবরের বিস্তারিত সাক্ষ্যপ্রমাণ তুলে ধরেছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলছে, ওই একটি রোহিঙ্গা গ্রামেই নিহত রোহিঙ্গার সংখ্যা সহিংসতার ঘটনায় মিয়ানমার সরকারের দেওয়া নিহতের সংখ্যার চেয়ে বেশি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের উপ এশিয়া পরিচালক ফিল রবার্টসন বলেন, সহিংসতায় এ পর্যন্ত চারশ নিহত হয়েছে বলে মিয়ানমার সরকারের দেওয়া তথ্য একটি বাজে কৌতুক। ঘটনা ধামাচাপ দিতে তারা তাদের নিজস্ব অনুসন্ধান চালানো অব্যাহত রেখেছে। আর এটা করা হচ্ছে নিষ্ঠুরতার ঘটনায় স্বাধীন অনুসন্ধানের গুরুত্বকে হালকা করার জন্য।
গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে ৬ লাখ ৭১ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশের জনাধিক্য ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। এদের অনেকেই শরীরে বুলেট এবং যৌন নির্যাতনের ক্ষত সঙ্গে এনেছে। যারা এসেছে তাদের ৬০ শতাংশই শিশু, আবার তাদের অনেকেরই পিতামাতা নেই। এই শিশুরা সামরিক বাহিনী কর্তৃক তাদের আত্নীয় স্বজনকে হত্যা এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছে।
মালয়েশিয়ার সংসদ সদস্য ও এপিএইচআর’র চেয়ারম্যান চার্লস সান্টিয়াগো বলেন, আমরা অনেক অনেক শিশু দেখেছি, যাদের পিতামাতাকে হত্যা করা হয়েছে। এই শিশুদেরকে কক্সবাজার নিয়ে এসেছে তাদের প্রতিবেশী কিংবা কোনো পথচারী।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার মতে, কমপক্ষে ৫,৬০০ শিশু যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে, এখন তারা তাদের পরিবারের কর্তা বনে গেছে। এবং ছোট ভাই-বোনের দেখাশোনার দায়িত্ব তাদের পালন করতে হচ্ছে তাদের। আগে ধারণা করা হয়েছিল, ২,৬৮০ শিশু তাদের পিতামাতার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন, নি:সঙ্গ, কিংবা এতিম। কিন্তু বাংলাদেশের দেওয়া নতুন তথ্য বলছে সংখ্যাটি আরো অনেক বেশি।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো সতর্ক করে বলছে, এই মাসের শেষে বৃষ্টিপাত শুরু হলে পরিস্থিতি আরো ভয়ানক হবে।
এ প্রসঙ্গে সান্তিয়াগো আরো বলেন, আমি সন্দেহ করছি বর্ষা আরম্ভ হলে মানবপাচার শুরু হয়ে যাবে। রোহিঙ্গারা ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া কিংবা অন্য যেকোন স্থানে যাওয়ার জন্যই বদ্ধপরিকর। ইত্তেফাক