‘খাবার চাওনা বাহে, অ্যাকনা কম্বল দেও’
রংপুর প্রতিনিধি : ‘মুই খাবার চাওনা বাহে, মোক অ্যাকনা কম্বল দেও। মরণের ঠাণ্ডার হাত থাকি বাঁচোং।’
রংপুরের কাউনিয়া বাসস্ট্যান্ডে পার্শ্ববর্তী তিস্তার ঢুষমারা চর থেকে আসা জমিলা বেওয়া (৬৫) সবার কাছে শীতের হাত থেকে বাঁচতে এভাবে আকুতি করছিলেন। গত এক সপ্তাহ ধরে রংপুর অঞ্চলে শৈত্যপ্রবাহের কারণে চরম দুর্ভোগে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষজন। বিশেষ করে তিস্তার চরাঞ্চলের অভাবি মানুষের শীত নিবারণে গণ অগ্নিকুণ্ডই একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারিভাবে শীতবস্ত্রও রয়েছে অপ্রতুল।
রংপুর অঞ্চলে জেঁকে বসেছে শীত। পরিণতিতে রংপুরের পাঁচ জেলায় প্রায় ১২ লাখ মানুষ শীতকাতর হয়ে পড়েছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী এসব মানুষের অধিকাংশই ভাসমান-যাদের কোনো শীতবস্ত্র নেই। সরকারি এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, প্রায় এক যুগ আগে উত্তর জনপদের বিভিন্ন এলাকায় ভূমিহীন ও অতিদরিদ্র পরিবারের যে জরিপ চালানো হয়েছে তাতে দেখা গেছে, খুব শীতের সময় পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিবারের দিনে গড় আয় ২৫ টাকা। এ কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী ওইসব পরিবারের লোকজনের পক্ষে কোনোভাবেই নিত্যদিনের খাবার যোগানের পর শীতবস্ত্র কেনার কোনো পয়সা থাকছে না। পরিণতিতে তারা শীত নিবারণের জন্য চট, ছালা, খড়ের লেপ ব্যবহারসহ সারারাত ধরে গণ অগ্নিকুণ্ড ব্যবহার করছে।
পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, উত্তরের ১৬ জেলার মধ্যে রংপুরে দারিদ্র্যসীমার নিচে পরিবার রয়েছে ৭৫ হাজার ৭৭৪ টি। এসব পরিবারের শীতবস্ত্রহীন মানুষের সংখ্যা তিন লাখ ৭৮ হাজার ৮৭০। এসব মানুষের অধিকাংশই বন্যা, নদীভাঙন এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগে নিঃস্ব হয়ে গেছে। এ জেলায় ভূমিহীনের সংখ্যা ১৭ দশমিক ৩। গাইবান্ধা জেলায় দারিদ্র্যসীমার নিচে পরিবার রয়েছে ৪১ হাজার ৩৬৪। শীতবস্ত্র অভাবে এসব পরিবারের দুই লাখ ৬ হাজার ৮২০ জন মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। এখানে ভূমিহীনের হার ১০ দশমিক ৮। কুড়িগ্রামে দারিদ্র্যসীমার নিচে পরিবার রয়েছে ৩৩ হাজার ৮৪০। এসব পরিবারের এক লাখ ৬৯ হাজার ২০০ জন মানুষ শীত কষ্টে ভোগে। যাদের অধিকাংশের কোনো শীতবস্ত্র নেই। কুড়িগ্রামে ভূমিহীনের হার ১১ দশমিক ০।
নীলফামারীতে দারিদ্র্যসীমার নিচে পরিবারের সংখ্যা ৭৫ হাজার ৭৭৫। শীতবস্ত্রহীন মানুষের সংখ্যা দুই লাখ ৬২ হাজার ২৭৫। ভূমিহীনের হার ১৯ দশমিক ৫। লালমনিরহাটে ৩২ হাজার ৯০০ পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। শীতকষ্টে ভোগে এক লাখ ৬৫ হাজার পাঁচজন মানুষ। ভূমিহীনের হার ১৭ দশমিক ৫। যদিও এই কয়েক বছরে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা অনেক বেড়েছে।
সরেজমিনে রংপুরের কাউনিয়ার তিস্তাকূলবর্তী বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, শীতে অভাবি মানুষজনের জীবন বাঁচানো দায় হয়ে পড়েছে। গরম কাপড় না থাকায় চরাঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ খড়কুটো সংগ্রহ করছে। শীত নিবারণে রাতে তারা আগুন জ্বালিয়ে শরীরের উষ্ণতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে।
ঢুষমারা চরের আব্দুস সোবহান (৬০) বলেন, ‘রাইতোত (রাতে) ছাওয়া-পোয়া (সন্তান) নিয়া গাদাগাদি করি থাকি। তবু গাও (শরীর) গরম হয় না।’ শীতের তীব্রতা এমন বৃদ্ধি পাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন চরাঞ্চলের অভাবি মানুষ।
রংপুর আবহওয়া অফিস জানায়, গত কয়েকদিনের মধ্যে রংপুরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নেমে আসে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আজ সোমবার সকালে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৭ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই সময় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠানামা করেছে ১৫ থেকে ১৬ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কাছাকাছি হওয়ায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বাতাসের আর্দ্রতা কাছাকাছি হওয়ায় বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হতে না পারায় সূর্যের নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে শীত জেঁকে বসেছে। এই অবস্থা আরো কয়েকদিন অব্যাহত থাকার কথা জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
ত্রাণ অফিস সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি জেলা থেকে যে পরিমাণ শীতবস্ত্রের চাহিদা পাঠানো হয়েছিল, এর বিপরীতে বরাদ্দ এসেছে খুব সামান্য। জেলাপ্রতি গড়ে চাহিদা ছিল এক লাখ পিস শীতবস্ত্র। এর বিপরীতে সরকারিভাবে বরাদ্দ এসেছে ৫৪ হাজার পিস। এসব শীতবস্ত্র ইতিমধ্যে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন উপজেলায় পাঠানো হয়েছে। অনেক স্থানে তা বিতরণও করা হয়েছে। তবে শীতের তীব্রতা বাড়লে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র নেই স্থানীয় প্রশাসনের কাছে। রংপুর ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘নতুন করে শীতবস্ত্রের চাহিদা পাঠানো হয়েছে।’