রোহিঙ্গা ইস্যুতে হার্ডলাইনে বাংলাদেশ
---
নিউজ ডেস্ক : রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ব্যাপক গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের ঢল কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। সীমান্তে অতিরিক্ত বিজিবি মোতায়েন ও সতর্কতা জারি করেও গত দুই সপ্তাহে নতুন করে আরো সাড়ে ৩ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। এ নিয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ। রোহিঙ্গাদের এই সে াত এখনো অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশের পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকেছে। এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সমস্যা দ্বিপাক্ষিক আলোচনার চেয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সমাধানে হার্ডলাইনে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কারণ, দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় নেয়া কোনো সিদ্ধান্তই শেষ পর্যন্ত মানেনি দেশটি।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের যতগুলো দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছে, তাতে ঐকমত্যে পৌঁছানো কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেনি দেশটি। শুধু তাই নয়, বৈঠকে চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া বিষয়গুলোও তারা বেমালুম ভুলে গেছে। রোহিঙ্গা ইস্যুটি নিয়ে মিয়ানমার বৈঠকের নামে বরাবরই সময়ক্ষেপণ করেছে। এখন সেখানে তারা গণহত্যা চালিয়ে সব রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়ার সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে। সূত্র আরো জানায়, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনার জন্য মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা উ থাং টুন গত জুলাইয়ে বাংলাদেশ সফর করেন। ওই সময় দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বাংলাদেশে ৪ লাখ রোহিঙ্গা থাকার কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন। উথাং টুন বলেন, আমি শুনেছি বাংলাদেশে মাত্র ২ হাজার রোহিঙ্গা আছে। তার কথা শুনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী বলেন, আপনি চাইলে হেলিকপ্টার প্রস্তুত, আপনি রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে আসুন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই প্রস্তাবে মিয়ানমারের এই উপদেষ্টা বলেছিলেন, সেখানে যাওয়ার অনুমতি তার সরকার দেয়নি। এরপরও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের খাতিরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের এই ধারণার প্রতিবাদ জানানো হয়নি।
পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক জানান, রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের কাছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে আসছে মিয়ানমার সরকার। অভিযোগটি হলো- রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনার জন্য মিয়ানমারের শীর্ষ ব্যক্তিদের কখনই ডাকেনি বাংলাদেশ। সচিব জানান, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মধ্যস্থতা করার জন্য গত এপ্রিলে ঢাকায় আসেন চীনের বিশেষদূত সান গোসিয়াং। ওই সময় চীনের বিশেষ দূত মিয়ানমারের এই অভিযোগ বাংলাদেশকে জানান। এ সময় রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অং সান সুচিসহ মিয়ানমারের শীর্ষ নেতাদের কাছে পাঠানো একাধিক আমন্ত্রণপত্রের অনুলিপি সান গোসিয়াং-এর হাতে তুলে দেয়া হয়। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলীর পাঠানো একাধিক আমন্ত্রণপত্রও ছিল। এ সময় বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ৪ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ফেরত পাঠাতে চীনের সহায়তা চায় বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র সচিব আরো জানান, মিয়ানমারের সাবেক সামরিক সরকারের চেয়ে বর্তমান নির্বাচিত অং সান সুচির সরকার অসহযোগিতা করছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে। কারণ, এর আগে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোনো কথা বলতে সে দেশের তৎকালীন সামরিক সরকারের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এখন এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে গেলে সুচির সরকারকে দেখিয়ে দেন দেশটির সামরিক কর্মকর্তারা, যারা সরকার নিয়ন্ত্রণ করছেন। ফলে পরিস্থিতি নিয়ে সে দেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রটি আরো জটিল হয়েছে।
বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিকরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ এতদিনে বুঝেছে দ্বিপাক্ষিকভাবে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এ জন্য রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য ‘সেফ জোন’ প্রতিষ্ঠা করতে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। আর রাখাইনে ‘সেফ জোন’ ছাড়া প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশ ছেড়ে রাখাইনে যেতেও চাইবে না। কাজেই এ ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের কথায় আশ্বাস না রেখে হার্ডলাইনে যেতে হবে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হচ্ছে। এরই ধারাবাহিতায় ইতিমধ্যে বাংলাদেশ জাতিসংঘ, রেডক্রস, আইওএমসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে রাখাইনে ‘সেফ জোন’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছে। এ ছাড়া রোববার ও সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ঢাকাস্থ বিদেশি কূটনীতিকদের ডেকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা চাওয়া হয়। আগামীকাল বুধবার এ কূটনীতিকদের সরেজমিন পরিদর্শনের জন্য কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নিয়ে যাচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া আল-জাজিরা, নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমকে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা তুলে ধরার জন্য ওই এলাকায় প্রবেশে বিশেষ অনুমতি দেয়া হয়েছে। এর আগে মিয়ানমার সরকারের আপত্তিতে রোহিঙ্গা এলাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া কোনো কূটনীতিক বা বিদেশি গণমাধ্যমের রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিল।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদও জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি ‘সেফ জোন’ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইনে নিজ ভূখণ্ডে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে। রোববার কাজাখস্তানের রাজধানী আস্তানায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের সময় রাষ্ট্রপতি হামিদ এ আহ্বান জানান। রাখাইনে ‘সেফ জোন’ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ওআইসির প্রতিও একই আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি। সবকিছু বিবেচনায় এনে রোহিঙ্গা প্রত্যার্পণে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া সম্ভব নয় বলে মনে করছে বাংলাদেশ এবং ধীরে ধীরে সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।মানবকণ্ঠ