কুমিল্লা-৫ আসনের নির্বাচনী হালচাল
---
বিশেষ প্রতিনিধি : কুমিল্লা বুড়িচং ব্রাহ্মণপাড়া নিয়ে ৫ সংসদীয় আসন। জাতীয় নির্বাচনের একবছর বাকী। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে প্রার্থীহতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতা। কেউ ছুটছেন হাওয়া ভবন নিয়ন্ত্রণকারী একাধিকমামলার ফেরারী আসামী লন্ডনে থাকা বিএনপি’র সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক জিয়ার নিকট। আবার কেউ আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের একাধিককেন্দ্রীয় নেতার নিকট ধর্ণা দিচ্ছেন একাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকার মাঝি হওয়ার টিকেট পাওয়ার জন্য।
আর এই টিকেট ক’জনের ভাগ্যে জোটে সেটা বিবেচনা করবে দু’দলের প্রধান। জেলার সীমান্তবর্তী বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া দুটি উপজেলানিয়ে কুমিল্লা ৫-সংসদীয় আসন গঠিত। এই দুটি উপজেলায় রয়েছে ১৭টি ইউনিয়ন। তার মধ্যে বুড়িচংয়ে ৯ টি এবং ব্রাহ্মণপাড়ায় ৮টি ইউনিয়ন রয়েছে। এই আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য সাবেক আইন মন্ত্রী আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এড. আব্দুল মতিন খসরু। ১৫/১৬ বছর যাবত দলীয় কমিটিগুলো না করায় কর্মী সমর্থকরা হতাশ।
অ্যাক্টিভকর্মীদেরকে বাদ রেখেই তিনি চলতি বছরের রমজান মাসে অর্ধশতাধিক সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। দুই উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাস্তা-ঘাট বিদুৎ, মসজিদ মাদ্রাসাসহ উন্নয়ন করলেও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বলতে গেলে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পরে এই দুই উপজেলায় কোন উন্নয়নই হয়নি। তাছাড়া এলাকার রাস্তাঘাট দেখলেই বুঝা যায়। দলীয় কমিটি নামক মুলা ঝুলিয়ে রেখে ২০০১ সাল থেকে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণকরে আসছেন তিনি। পদলোভী কিছুসংখ্যক কর্মীসমর্থক নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দাওয়াত খেয়ে বেড়ান। ফলে কমিটি নাপাওয়া আওয়ামী লীগসহ অঙ্গসংগঠনে একাধিক গ্রুপিং সৃষ্টি হয়েছে।
আর এই বিভেদের কারণে আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত ফায়দা লুটে নেওয়ার চেষ্টা করবে বলে নেতাকর্মীদের মাঝে বলাবলিও হচ্ছে। সাধারন মানুষকে বিভ্রান্ত করে তাদের স্বার্থ হাসিল করে ভোটের বাজার চাঙ্গাকরে তুলছেন। ২০১৩ সালে জামায়াতের নাশকতাকারীরা পালিয়ে থাকা নেতা-কর্মীরা ইতিমধ্যে মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করে ভোট ব্যাংক তাদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছেন। ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর খান চৌধুরী ও উপজেলা নির্বাচনে পরাজিত আওয়ামী লীগ নেতা আলহাজ্ব আবু তাহের দুইভাগে বিভক্ত। মিস্টার পারসেন্টিজখ্যাত উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর খান চৌধুরী ৮টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের উপজেলানির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
দলীয় কমিটির সদস্যদেরকেও কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রন করেন। প্রশ্নবিদ্ধ পকেট কমিটির পদ-পদবী হারানোর ভয়ে টু-শব্দ করার সাহস নেই কারোর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রভাবশালী নেতা বলেন, সময়মত ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যানের দুর্নীতির ফিরিস্তি তুলে ধরা হবে। রষ্ট্রীয় কোন সভা-সমাবেশে আবু তাহের অংশগ্রহণ না করলেও তার ব্যক্তিগত অর্থায়নে এলাকার বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছে প্রতিনিয়ত। স্থানীয় লোকজন জানান, তাদের এই দন্দের সুত্রপাত বিগত উপজেলা নির্বাচনে দল থেকে আলহাজ্ব আবু তাহের মনোনয়নের জন্য জোর দাবী জানিয়েছিল ওই আসনের এমপি আব্দুল মতিন খসরুর কাছে। উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থীতায় দলীয় সিদ্ধান্ত জাহাঙ্গীর খান চৌধুরীকে দেওয়া হয় এবং কথিত আছে, গোপনে শপথ করে আলহাজ্ব আবু তাহেরকে স্বতন্ত্রপ্রার্থী করিয়ে দেন তিনি। নির্বাচন ঘনিয়ে আসলে তখন এমপি আব্দুল মতিন খসরুর অবস্থান জানতে বাধ্য করা হলে এবং প্রশ্নবিদ্ধ পদ্ধতিতে দলীয় প্রার্থীকে জিতিয়ে আনেন। সে থেকে দু’ব্যক্তির দন্দের দলের মধ্যে যেমন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে তেমনি করে মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও দুভাগে বিভক্ত।
এরই মাঝে ২০০৭ সালের ২২জানুয়ারির নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া থেকে নতুন সংযোজন হলো জাহাঙ্গীর খান চৌধুরীর নাতি ব্যারিস্টার সোহরাব খান চৌধুরীর আওয়ামী লীগের এমপি প্রার্থী হিসেবে মাঠে বিচরণ। বিবদমান গ্রুপগুলোই গোপনে গোপনে ব্যারিস্টার সোহরাব খান চৌধুরীকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে যদি আবার নতুন মুখ হিসেবে দলীয় প্রার্থীতা পেয়ে যায়। ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায় বিএনপি’র সাংগঠনিক অবস্থা নাজুক হলেও এখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ আগামী সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে প্রার্থী হওয়ার ঘোষনা দিলে তৃণমূল পর্যাযের নেতা-কর্মীরা চাঙ্গা হয়ে উঠে। তিনি কুমিল্লায় আসলে ছাত্রদল নেতা-কর্মীরা স্লোগানে-স্লোগানে মূখরিত হয়ে উঠে। আবার তিনি চলে গেলে নেতা-কর্মীদের আর খুঁজে পাওয়া যায়না।
বুড়িচংউপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি পদে মিজানুর রহমান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আত্মগোপনে থেকে দল পরিচালনা করলে ও উপজেলা প্রশাসন কৌশলে চালিয়ে যাচ্ছেন উপজেলার কার্যক্রম। লুটপাট করা হচ্ছে সরকারের কোটি-কোটি টাকা। উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা মিটিং, উপজেলা চেয়ারম্যান না হাজির থাকলেও হাজিরা খাতায় তার স্বাক্ষর থাকে। নেতা-কর্মীরা বিপদে আপদে তাকে পাশে পায়না। আওয়ামী লীগের সাথে গোপন যোগাযোগ করে কোন রকমে টিকেআছেন।
জনগণের প্রশ্ন তিনি নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েও কেন উপজেলায় থাকেন না। আর ময়নামতি ইউনিয়ন এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছেন ইউপি চেয়ারম্যান লালন হায়দার তার বড় ভাই কুমিল্লা জেলা পরিষদ সদস্য তারিখ হায়দার। ওই এলাকার নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যক্তি জানান, বুড়িচং এলাকার পশ্চিম অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ ও রাজত্ব করছেন তারা তিন ভাই এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা একটি বিশাল বাহিনী। যাদের দ্বারা এলাকায় সন্ত্রাসী চাঁদাবাজি, খুন, ডাকাতি, জমিদখল, সংখ্যালঘু যুবতীদের রাতের আধাঁরে ইজ্জত লুণ্ঠণসহ মাদক ব্যবসা সবই হয়।
কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেনা। এদের কাউকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আটকের চেষ্টা করলে তাদের উপরও সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার। কখনো পুলিশের হ্যান্ডকাপ নিয়ে আসামী ছিনতাই, কখনো পুলিশের উপর হামলা চালিয়ে আসামী ছিনিয়েনেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এলাকার কোন মানুষ নির্যাতিত হলে প্রতিবাদ করলে তাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানী করা হয়। ফলে ময়নামতি, ভারেল্লা উত্তর ও দক্ষিণ এবং মোকাম ইউনিয়নের মানুষ তাদের নেতৃত্বের কারণে আওয়ামী লীগ বিমূখ হয়ে পড়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এনিয়ে অভিযোগ করলে এমপি আমলে নিচ্ছেন না বলেও অভিযোগ ওঠেছে। যা আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বুড়িচং উপজেলা সাবেক চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেন স্বপন। তিনি দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক রেলপথ মন্ত্রী মুজিবুল হক মুজিব অনুসারী হওয়াতে তার নির্বাচনী এলাকার এমপি ছাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ ও এর অংগসগঠনের নেতা-কর্মীদের সাথে তেমন কোন যোগাযোগ রাখছেন না বিগত সময়ের মত। আওয়ামী লীগ দলীয় নির্দেশ অমান্য করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে কুমিল্লা জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে প্রতিদন্দিতা করে হেরে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ও দলীয় ভাবে কোনঠাসা হওয়ায় উপজেলায় আওয়ামী লীগের অংগসংগঠনের নেতা-কর্মীদের সাথেও কোন রাজনৈতিক সম্পর্ক তেমন একটা রাখছেন না বলেও একাধিক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুত্র দাবি করে। তাছাড়া গ্রুপিংয়ের কারনে বুড়িচং উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি সারোয়ার আলম পলাশ হত্যা মামলার অভিযোগ তো আছেই এই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানের উপর এবং বুড়িচং উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যানএডভোকেট রেজাউল করিম খোকনকে ২০০১ সালে হত্যা চেস্টার অভিযোগসহ দীর্ঘদিনের দন্দ তো আছেই তার বিরুদ্ধে।
বুড়িচং উপজেলা চেয়ারম্যান থাকাকালে লাগামহীন দুর্নীতির করনে গঠিত তদন্তের রিপোর্টও প্রকাশ করেনি। ফলে বুড়িচং উপজেলায় ত্রিধাবিভক্ত আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ, দুস্কৃতিকারীদের দলের প্রভাবমুক্ত সাধারন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিতকরতে না পারলে নৌকার প্রার্থীর পরাজয় সুনিশ্চিত বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়দলের কর্মীদের চাওয়া নতুন মুখের প্রার্থী দিলে আভ্যন্তরিণ কোন্দল প্রশমিত হয়ে সুষ্ঠ নির্বাচন হতে পারে। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সত্যিকারের জনপ্রিয়তা প্রকাশ পাবে। কুমিল্লা-৫ সংসদীয় আসনে যারা মনোনয়ন প্রত্যাশী আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি আব্দুল মতিন খসরু, ব্যারিষ্টার সোহরাব খান চৌধুরী, বিএনপি’র দলছুট নেতা সাবেক এমপি অধ্যক্ষ মোঃ ইউনুছ, খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা শওকত মাহমুদ, বিএনপি’র সিনিয়র ভাইন চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ট বন্ধু শিল্পপতি এএসএম আলাউদ্দিন প্রমূখ।
বর্তমানে বুড়িচং ভোটার সংখ্যা ২লাখ ৬৬ হাজার ৯৩ জন। ব্রাহ্মণপাড়ায় ১ লাখ ৪৬ হাজার ১শত ৬জন ভোটার রয়েছেন। দুই উপজেলার সংখ্যালঘু ভোটার প্রায় ৩০ হাজার। এরাই নির্ধারন করবে কে হবে আগামীতে এই আসনের সংসদ সদস্য।