উদাসীনতা: পর্যটনে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ
---
নিজস্ব প্রতিবেদক : দুঃখজনক হলেও সত্য, অপার সম্ভাবনার পরও পর্যটনে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, পর্যটক আকর্ষণে বিশ্বের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর একটি হলো বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ব পর্যটনে ১৩৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান হলো ১২৫। দক্ষিণ এশিয়ার ৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে সর্বনিম্নে অর্থাৎ ৫ নম্বরে। এমনকি আত্মঘাতী বোমা হামলায় জর্জরিত দেশ পাকিস্তানও এক ধাপ ওপরে!
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ‘ভ্রমণ ও পর্যটন প্রতিযোগিতা সূচক ২০১৭’ শীর্ষক প্রতিবেদনে সম্প্রতি বাংলাদেশের পর্যটন খাত নিয়ে এমন হতাশাজনক চিত্র ফুটে উঠেছে। পর্যটক আকর্ষণে একটি দেশ কতোটা নিরাপদ, অবকাঠামো সুবিধা কেমন, বিমানবন্দর কতোটা উন্নত, সেদেশে আবাসন ব্যবস্থার মান কেমন- এমন ১৪টি বিষয় বা সূচকের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। প্রতিটি সূচকে সর্বোচ্চ নম্বর ছিলো ৭, আর সর্বনিম্ন নম্বর ছিল ১। একেকটি সূচকে প্রাপ্ত নম্বর গড় করে একটি দেশের সার্বিক নম্বর নির্ধারণ করা হয়। সেই অনুযায়ী ক্রমতালিকাটি করা হয়েছে।
জানা গেছে, বিশ্বে ভ্রমণ ও পর্যটনশিল্প নিয়ে প্রতি দুই বছর পরপর ডব্লিউইএফ এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০১৫ সালেও প্রায় একই অবস্থা ছিল। সেসময় সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে ১৪১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো ১২৭।
প্রতিবেদন তৈরিতে বাংলাদেশ-বিষয়ক তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কাজ করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। বাংলাদেশে ব্যবসা রয়েছে, ১০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে, দেশি-বিদেশি এমন ৮৭ কোম্পানির নির্বাহীদের মতামত এই প্রতিবেদনে ব্যবহার করা হয়।
বিষয়টি সম্পর্কে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সহযোগী গণমাধ্যমকে বলেন, বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে যে ধরনের ব্যাপকভিত্তিক অবকাঠামোগত সুবিধা থাকা প্রয়োজন, বাংলাদেশে তার বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। শ্রেণি অনুযায়ী পর্যটক আকর্ষণে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালাও বাংলাদেশের নেই। পর্যটনে বাংলাদেশের এসব ঘাটতিই প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, পর্যটক আকর্ষণে বিশ্বের ১ নম্বরে রয়েছে স্পেন। দেশটির স্কোর ৫ দশমিক ৪৩। অপরদিকে ১২৫ নম্বরে থাকা বাংলাদেশের স্কোর ২ দশমিক ৯। শীর্ষ দশে থাকা অন্য দেশগুলো হলো যথাক্রমে ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি ও কানাডা। পর্যটক আকর্ষণে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ভারত। তালিকায় ভারত রয়েছে ৪০ নম্বরে। তাছাড়া ভুটান ৭৮ নম্বরে, নেপাল ১০৩ এবং পাকিস্তান রয়েছে ১২৪ নম্বরে।
যে ১৪টি সূচকের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ১২৫ নম্বরে তার প্রথমেই রয়েছে বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশ। এই সূচকে বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থান হলো ১০৪। বাংলাদেশে একটি ব্যবসা শুরু করতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের যে সকল প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়, সে বিষয়গুলো এই সূচকে তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বিমানবন্দর অবকাঠামো সুবিধায় বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩। তার মধ্যে বিমানবন্দরের ঘনত্ব সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান হলো ১৩৪। প্রতি ১০ লাখ লোকের জন্য একটি দেশে কতোটি বিমানবন্দর রয়েছে, সেটিই এই সূচকে তুলে ধরা হয়েছে। সেই হিসেবে বাংলাদেশের বিমানবন্দরেও যাত্রীর চাপ অনেক বেশি।
অপরদিকে পর্যটকদের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সূচকে বাংলাদেশ ১৩৩ নম্বরে। পর্যটকদের আবাসন কিংবা হোটেলের মান সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে নিচে। এই সূচকে বাংলাদেশ রয়েছে ১৩৫ নম্বরে। অর্থাৎ শেষের দিক দিয়ে দ্বিতীয় স্থানে।! বাংলাদেশে ভ্রমণে এসে ভাড়া গাড়ির সেবার দুরবস্থার বিষয়টিও উঠে এসেছে এই প্রতিবেদনে। এই সূচকে ১৩৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে ১২৯ নম্বরে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, পর্যটনশিল্পের প্রসারের বিষয়টি বাংলাদেশে একেবারেই গুরুত্বহীন। এই সূচকে বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থান হলো ১২৭। সরকারের অগ্রাধিকার খাত সূচকে বাংলাদেশ রয়েছে ১১১ নম্বরে। অর্থাৎ পর্যটন খাতের উন্নয়নের বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের অগ্রাধিকার তালিকাতে নেই। পর্যটক আকর্ষণে প্রচার, তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ, ব্র্যান্ডিংয়ের মতো সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান ১২০ হতে ১৩০-এর মধ্যে।
ডব্লিউইএফের প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, বাংলাদেশে পর্যটকদের নিরাপত্তার ঘাটতির বিষয়টিও। এই সূচকে বাংলাদেশ রয়েছে ১২৩ নম্বরে। নিরাপত্তা সূচকে উঠে এসেছে বাংলাদেশে পুলিশের সেবার বিশ্বস্ততার বিষয়টি নিয়েও। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ রয়েছে ১১৭ নম্বরে। অর্থাৎ পুলিশের সাহায্য নেয়ার ক্ষেত্রে পর্যটকরা তেমন একটা আস্থাশীল নন।
সরকারি হিসাব মতে, ২০১৬ সালে পাঁচ লাখের বেশি পর্যটক বাংলাদেশে এসেছে। আগের বছরে ছিল সাড়ে চার লাখের মতো। একই সময়ে প্রতিবেশী দেশ নেপালে পর্যটক এসেছেন সাত লাখ ২৯ হাজার, একই সময়ে ভারতে এসেছে প্রায় ৯০ লাখ পর্যটক।
এ বিষয়ে পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ব্যবসায়িক কাজে যারা বাংলাদেশে আসেন, তাদের পর্যটক বলা যুক্তিযুক্ত নয়। তবে ব্যবসায়ীদের এমন মনোভাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের জনসংযোগ বিভাগের ব্যবস্থাপক জিয়াউল হক হাওলাদার বলেন, বিদেশি একজন নাগরিক তিনি যে প্রয়োজনেই বাংলাদেশে আসুন না কেনো, তিনি পর্যটক হিসেবেই গণ্য হন।
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে সম্ভাবনা থাকা সত্বেও পর্যটন খাতকে এগিয়ে নেয়া যায়নি। এর পেছনে মৌল কারণ হচ্ছে উদাসীনতা। অথচ এই খাতটি এগিয়ে নিতে হলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সরকারকে নিতে হবে। তাহলে এই পর্যটন খাত আমাদের দেশের কৃষ্টি-কালচার যেমন বহির্বিশ্বে প্রকাশ পাবে পক্ষান্তরে এই খাত থেকে আমরা প্রচুর বৈদেশি মুদ্রাও অর্জন করতে পারবো।