রোজার পরিচয়, গুরুত্ব বা তাৎপর্য
---
মাওলানা মিরাজ রহমান : মানুষের সমগ্র জীবনকে আল্লাহ পাকের ইবাদত-বন্দেগিতে নিয়োজিত করাই ইসলামের আসল উদ্দেশ্য। চিন্তা ও কর্মের দিক দিয়ে এক মুহূর্তের জন্যও আল্লাহর ইবাদত পরিত্যাগ করা উচিত নয়। জীবনের প্রতিটি কাজে এবং চিন্তায় দেখতে হবে কিসে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি আর কিসে অসন্তুষ্টি। যে কাজে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি আছে সে কাজই করা প্রতিটি মুমিনের কর্তব্য। আর যে কাজ আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল (সা.) পছন্দ করেন না, সে কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে।
ইবাদত কী: ইবাদতের অর্থ আল্লাহ পাকের আনুগত্য করা, তাঁর হুকুম মানা, নিজেকে আল্লাহ পাকের নিকট সোপর্দ করে দেয়া। নিজের আজাদী এবং স্বাধীনতাকে স্বেচ্ছায় পরিহার করে আল্লাহর বাদশাহী এবং আনুগত্যকে মাথানত করে সর্বান্তকরণে স্বীকার করে নেয়া। অর্থাৎ, জীবনের সকল ক্ষেত্রে কাজে-কর্মে আল্লাহকে মেনে চলা, পবিত্র কুরআন এবং হুজুর (সা.)-এর সুন্নাতের চিরসুন্দর ও চিরকল্যাণকর আদর্শ মোতাবেক জীবন-যাপন করা। অর্থাৎ যেভাবে, যে নিয়মে ইবাদত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেভাবে ইবাদত করা। নিয়মের ব্যতিক্রম করা হলে সে কাজগুলোকে ইবাদতের পর্যায়ে ফেলা হবে না বরং গুনাহ হবে।
আল্লাহ পাক কী নির্দেশ দিয়েছেন: মুমিনদের প্রতি আল্লাহ পাকের নির্দেশ হলো- দৈনিক পাঁচবার নামাজ পড়তে হবে, রমজান মাসের রোজা রাখতে হবে, মালদার হলে যাকাত দিতে হবে এবং জীবনে একবার হজব্রত পালন করতে হবে। উপরিউক্ত চারটি কাজ প্রতিটি মুমিন বান্দার উপর ফরজ বা অবশ্য করণীয়। তবে এ চারটি কাজ বান্দার উপর তখনই ফরজ হয় যখন বান্দা আল্লাহ পাকের প্রতি ঈমান আনে। আর ঈমান হলো আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন করা, তার সাথে কাউকে শরিক না করা এবং হুজুরে পাক (স)-কে আখেরী নবী হিসেবে স্বীকার করে নেয়া।
শুধুমাত্র কালিমা পড়ার নাম কিন্তু ইসলাম নয়। মুসলমান তখনই বলা হবে যখন সে কালিমা মুখে পাঠ করবে, অন্তরে বিশ্বাস করবে এবং কাজে-কর্মে বাস্তবায়িত করবে। এর একটির অনুপস্থিতিতে সে ব্যক্তি মুসলিম বলে স্বীকৃতি পাবে না। কাজেই সে পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে প্রথম তিনটি বিষয় প্রত্যেক মুমিনের জন্য অবশ্য কর্তব্য। বাকি দুইটির জন্য শর্ত হলো মালদার হওয়া। প্রথম তিনটি বিষয়ের মধ্যে তৃতীয়টি হলো রোজা।
রোজা কী: রোজা ফারসী শব্দ। অর্থ উপবাস। রোজার আরবী শব্দ হলো ‘সাওম’। আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। শরীয়তের পরিভাষায় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার এবং কামাচার থেকে বিরত থাকা। আত্মিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভের এক দুর্লভ সুযোগ এনে দেয় মাহে রমজানের রোজা। মানুষের মধ্যে পশু প্রবৃত্তি ও কু-প্রবৃত্তি আছে, সেগুলো মানুষকে অন্যায় পাপাচারে লিপ্ত করে, রোজা সে কু-প্রবৃত্তিগুলোকে দমন করে আত্মশুদ্ধি লাভের মহা সুযোগ এনে দেয়। সকল প্রকার অকল্যাণকর কাজ থেকে বিরত রেখে আল্লাহ পাকের খাঁটি বান্দা হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার সুযোগ এনে দেয় এই রোজা।
রোজার গুরুত্ব ও তাৎপর্য: মাহে রমজানের রোজার গুরুত্ব যে কত বেশি হুজুর পাক (সা.)- এর নিম্নের হাদিসটিই তার প্রমাণ। হুজুর (সা.) বলেন, আল্লাহ পাক হাদিসে কুদসিতে বলেন, রোজা আমার জন্য আর আমিই এ প্রতিদান দেব। অন্য এক হাদিসে আছে, ‘আমিই এর প্রতিদান।’ রোজাকে আল্লাহ পাকের সাথে সম্পর্কিত করার কারণ হলো এই যে, রোজাই একমাত্র ইবাদত যার মধ্যে লোক দেখানোর সম্ভাবনা থাকে না। রোজা রাখলে অন্যেরা বুঝতে পারে না। আর না রাখলেও যদি কেউ বলে আমি রোজা রেখেছি তা হলেও কেউ প্রমাণ করতে পারবে না যে, সে রোজা রাখেনি। মানুষ তখনই বুঝতে পারে, যখন সে লোকসম্মুখে পানাহার করে। কাজেই রোজা একমাত্র আল্লাহ পাককে ভয় করেই রাখা হয়।
রোজাই একমাত্র ইবাদত যার সওয়াব এবং ফজিলতও নির্ধারণ করা হয় নাই। যেমন; অন্যান্য ইবাদতের বেলায় আল্লাহ পাক বলেছেন, যে একটি সৎকর্ম করবে সে তার দশগুণ পাবে এবং যে একটি মন্দ কাজ করবে সে তার সমান শাস্তিই পাবে। বস্তুত তাদের উপর জুলুম করা হবে না। (সূরা আনআম : ১৬)
হুজুর (সা.) বলেন, তোমাদের প্রতিপালক অত্যন্ত দয়ালু। কারণ যে ব্যক্তি কোন সৎকাজের শুধু ইচ্ছে করে, তার জন্য একটি নেকী লেখা হয়, ইচ্ছাকে কর্মে পরিণত করুক বা না করুক। অতঃপর যখন সে সৎ কাজটি সম্পাদন করে, তখন তার আমলনামায় দশটি নেকী লেখা হয়। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কোন পাপ কাজের ইচ্ছে করে অতঃপর যদি সে ইচ্ছেকে কর্মে পরিণত করে, তবে একটি গুনাহ লেখা হয়, এহেন দয়া ও অনুকম্পা সত্ত্বেও আল্লাহর দরবারে ঐ ব্যক্তিই ধ্বংস হতে পারে, যে ধ্বংস হতেই দৃঢ়সংকল্প (বুখারী, মুসলিম ও নাসায়ী)
উপরিউক্ত হাদিস দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, সৎকাজের প্রতিদান দশ গুণ দেয়া হবে এবং এটা সর্বনিম্ন। আল্লাহ পাক স্বীয় কৃপায় আরো বেশি দিতে পারেন এবং দেবেনও। অন্যান্য হাদীস দ্বারা সত্তরগুণ বা সাতশতগুণ পর্যন্ত প্রমাণিত রয়েছে। কিন্তু রোজার বেলায় তার ফজিলত নির্ধারিত হয় নাই। আল্লাহ পাক তার নিজ হাতে এর প্রতিদান দেবেন।
হাদিসে এসেছে, রোজা আল্লাহ পাক-এর নিকট সবচেয়ে প্রিয় বন্দেগী। উপরোক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় মোফাচ্ছেরিনগণ বলেছেন, রোজা আল্লাহ পাকের গুণাবলীর অনুরূপ। কারণ আল্লাহ পাক পানাহার এবং অন্যান্য সকল প্রয়োজন থেকে মুক্ত ও পবিত্র। রোজাদার ক্ষণিকের জন্য হলেও এই গুণটি অর্জনে সচেষ্ট হয়।
রোজা বান্দাকে আল্লাহ পাকের নৈকট্য ও সান্নিধ্য লাভের সুযোগ এনে দেয়। রোজার ফজিলত অপরিসীম। রমজানের রোজার মাধ্যমে মানুষ লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ এবং সকল প্রকার অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকার সুযোগ পায়।
হজরত সালমান ফারসী (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে হুজুর পাক (স) শাবানের ২৯ তারিখে এক ভাষণে বলেন, হে লোক সকল! একটি বরকতের মাস তোমাদের দ্বারে সমুপস্থিত। এই মাসে এমন একটি রাত রয়েছে, যে রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়ে উত্তম। আল্লাহ পাক এ মাসের রোজা ফরজ করেছেন। এ মাসে ইবাদত অতি সওয়াবের কাজ। এই মাসে কেউ যদি একটি নফল ইবাদত করে তবে তার সওয়াব অন্য মাসের ফরজের সমতুল্য দেয়া হবে। আর এই মাসের ফরজের সওয়াব অন্যান্য মাসের সত্তরটি ফরজের সমতুল্য।
রমজান ধৈর্যের মাস। আর ধৈর্যের প্রতিদান বেহেশত। এই মাস পরস্পর সহানুভূতি ও সদ্ব্যবহারের মাস। এ মাসে মুমিনের রিজিক বৃদ্ধি করে দেয়া হয়। এ মাসে যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে তার গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে এবং দোযখ থেকে নাজাত দেয়া হবে। এতে রোজাদারের সওয়াবের কোনো কমতি হবে না। উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামগণ আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অনেক রোজাদারকে ইফতার করাবার সামর্থ্য রাখে না। (প্রিয়নবী (সা.) ইরশাদ করলেন, শুধুমাত্র একটি খেজুর, একটু দুধ বা পানি দ্বারা ইফতার করানোই যথেষ্ট হবে। এই রমজানের প্রথম দশ দিন রহমতের, দ্বিতীয় দশ দিন মাগফিরাতের এবং তৃতীয় অংশ দোযখ থেকে মুক্তিলাভের। যে ব্যক্তি তার অধীনস্থ লোকদের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে আল্লাহ পাক তার গোনাহ মাফ করে দেবেন।