ইনসুলিন পাম্প কি? এটি কিভাবে কাজ করে?
স্বাস্থ্য ডেস্ক : সুস্থ শরীরে অগ্ন্যাশয় বা প্যানক্রিয়াস থেকে ২৪ ঘণ্টায় কিছু কিছু ইনসুলিন নির্গত হতে থাকে যাকে বলা হয় বেজাল ইনসুলিন। এছাড়া প্রতিবার খাদ্য গ্রহণের পর রক্তশর্করার যে বৃদ্ধি ঘটে তার জন্য নির্গত হয় তা হল বোলাস ইনসুলিন। বেজাল ইনসুলিন খালি পেটে, খেতে দেরি হলে ও মাঝ রাতে রক্তশর্করা যে বৃদ্ধি হয় তাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
কৃত্রিমভাবে বাইরে থেকে দিনে ৩-৪ বার ইনসুলিন দিয়ে ও সুস্থ শরীরে অগ্ন্যাশয়ের মতো কিছুতেই এ ধরনের কাজ পাওয়া সম্ভব নয়।
ইনসুলিন পাম্প এ সমস্যার অনেকটাই সমাধান করতে সাহায্য করেছে। ইনসুলিন পাম্পের সাহায্যে রোগী নিজে খাওয়ার পরিমাণ অনুযায়ী বোলাস ইনসুলিন ডোজ মেশিনে নির্দিষ্ট করে দিলে ঠিক ওই পরিমাপেই ইনসুলিন শরীরে পৌঁছে যাবে।
পরবর্তী খাওয়ার মাঝে অতিরিক্ত ইনসুলিন প্রয়োজন হলে তাও দেয়া যাবে। আবার ওই পাম্পের মাধ্যমে বেজাল ইনসুলিনের ডোজ নির্দিষ্ট করে দিলে ২৪ ঘণ্টা ধরে অল্প অল্প ইনসুলিন শরীরে প্রবেশ করবে ও বিপাকীয় পদ্ধতি নিয়ন্ত্রিত রাখবে। এতে খালি পেটে ডায়াবেটিস কিটোঅ্যাসিডোসিস ও প্রতিরোধ করা যাবে।
বর্তমানে ইনসুলিন পাম্প ছোট দেশলাই বাক্সের মতো মাপের। এর ওজন মাত্র ১২০ গ্রাম ও সহজেই প্যান্টের পকেটে বেল্টের সঙ্গে অথবা মোজা বা মহিলাদের ব্রেসিয়ারের মধ্যে রাখা যায়। পাম্পের মধ্যে চালিত ইনসুলিন সিরিঞ্জ ইনসুলিনকে শরীরে প্রবেশ করায়। এ সিরিঞ্জের মাপ ৩ মিলি ও ৩০০ ইউনিট ইনসুলিন বহন করে।
পাম্প থেকে লম্বা টিউবের শেষ প্রান্তে, নমনীয় ক্যাথেটার থাকে যা তলায় প্রবেশ করিয়ে রাখা হয়। পেটের ওপরে বা উরুদেশে বা হাতের ওপরে অংশে (ট্রাইসেপ অঞ্চলে) এ ক্যাথেটার লাগানো যেতে পারে। প্রতি তিন থেকে ছয়দিন পর সিরিঞ্জ ও ইনফিউশন সেট বদল করতে হয়।
মেশিনের ব্যাটারি ৫-৮ সপ্তাহ পর বদল করতে হয়। মেশিনে কোনো রকম গোলমাল দেখা গেলে মেশিনের অ্যালার্ম সতর্ক করে দেয়। গোসল করা, সাঁতার কাটার সময় ক্যাথেটার চামড়ায় তলায় অক্ষত রেখে খুব সহজেই পাম্প ও টিউব খুলে নেয়া যায় ও আবার লাগিয়ে দেয়া যায়।
পাম্পের ব্যবহার করার জন্য সলিউবল হিউমান ইনসুুলিন বা র্যাপিড অ্যাকটিৎ অ্যানালগ যেমন অ্যাসপার্ট লিসপ্রো বা গ্লুলিসিন ইনসুলিনের প্রয়োজন। অ্যানালগ ইনসুলিন পাম্পের জন্য সবচেয়ে ভালো কাজ দেয়।
ইনসুলিনের ডোজ ঠিক করার জন্য প্রতিবার খাওয়ার আগে ও খাওয়ার পরে এবং শোওয়ার সময় ও ভোর তিনটায় গ্লুকোমিটার সাহায্য ব্লাডসুগার পরীক্ষা করতে হবে. বর্তমানে গবেষণা চলছে ইনসুলিন পাম্পের সঙ্গে অটোমেটিক গ্লুকোজ সেন্সর জুড়ে দেয়ার। এই যন্ত্র নিজে নিজে ব্লাডসুগার পরীক্ষা করে নিজে থেকে ইনসুলিন ডোজ নির্ধারণ করে বেজাল ও বোলাস ইনসুলিন শরীরে প্রবেশ করাবে।
পাম্প চালু করার সময় রোগী সিরিঞ্জে যে ইনসুলিন ডোজ নিচ্ছে তার ওপর ভিত্তি করে ১০-২০ শতাংশ কমিয়ে ডোজ ঠিক করতে হবে। বোলাস ডোজ ইনসুলিন পাম্প বিভিন্নভাবে দিতে পারে। যেমন স্ট্যান্ডার্ড বোলাস, স্কয়ারওয়েভ বোলাস ও ডুয়াল ওয়েভ বোলাস।
এই নির্বাচন নির্ভর করে পাম্প ব্যবহারকারী একবার খাবেন, না বেশ কয়েকবার অল্প অল্প খাবেন, মিষ্টি ও চর্বি জাতীয় খাদ্য খাচ্ছেন কিনা তার ওপর। সাধারণত মোট ইনসুুলিনের ৬০ শতাংশ বোলাস ডোজ হিসেবে দিতে হয়।
ইনসুলিন পাম্পের সুবিধা
* কঠোর ভাবে ব্লাডসুগার নিয়ন্ত্রণের একমাত্র পথ।
* খাওয়ার, কাজকর্ম ও দৈনন্দিন অভ্যাস বজায় রেখে ইনসুুলিন সময় ঠিক করে নেয়া যায়।
* প্রয়োজনে খাদ্য গ্রহণ বাদ দিয়ে বা পিছিয়ে দিয়েও সুগার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
* প্রতিদিন ৪ বার সূচ না ফুটিয়ে ৩-৬ দিন ছাড়া ১ বার ফোটালেও চলে।।
* বিদেশে (অন্য মাহাদেশে) বেড়াতে গেলে সময় পরিবর্তন জন্য সুগার নিয়ন্ত্রণ যে সমস্যা হয় তা পাম্পের ক্ষেত্রে হয় না।
পাম্পের সমস্যা
* ব্যয়বহুল।
* সারাদিন শরীরেপাম্প লাগিয়ে রাখতে হবে।
* হঠাৎ করে ব্যাটারি অথবা ইনসুলিন ফুরিয়ে গেলে বা মেশিন খারাপ হয়ে বা ক্যাথেটার বন্ধ হয়ে গেলে ইনসুলিন যেতে পারে না। তখন কিন্তু সুগার খুব বেড়ে যেতে পারে বা কিটো অ্যাসিডোসিস হয়ে যেতে পারে। অবশ্য বর্তমানে উন্নত মানের পাম্পের অ্যালার্ম এই অবস্থায় থেকে বাঁচায়।
* ক্যাথেটার চামড়ায় প্রবেশে জায়গায় ইনফেকশন।
* বিমানে যাওয়ার সময় সুরক্ষা বিচারকদের পাম্পের কাগজ দেখাতে হয়। না হলে তারা পাম্পকে অন্য কিছু সন্দেহ করে।
পাম্প কখন অবশ্য দরকার
* ৪ বার ইনসুলিন দিয়েও যখন ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণ আসে না।
* লং অ্যাকটিং ইনসুলিনের দ্বারা যখন মাঝ বা ভোর রাতের ব্লাডসুগার কমান যায় না।
* যখন ঘন ঘন হাইপোগ্লাইসিমিয়া হয়।
* গর্ভাবস্থায় আগে বা গর্ভাবস্থায় চলাকালিন যখন কঠোর নিয়ন্ত্রণ দরকার।
* পাকস্থলীর নার্ভের অসুখ।
* উচ্চ পদের ব্যক্তিরা। যাদের খাওয়া, ইনজেকশন নেয়ার সঠিক সময় বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
চামড়ার তলায় পাম্পের সহায়তা ইনসুলিন দিয়ে যে ফল পাওয়া যায়, পেটের মধ্য সরাসরি ক্যাথেটার দিয়ে দিতে পারলে কাজ অনেক ভালো হয়। বর্তমানে সুইজারল্যান্ডে এই নিয়ে পরীক্ষা চলছে, ছোট অপারেশন করে পেটের মধ্য একটা টাইটেনিয়াম পোর্ট ঢুকিয়ে দেয়া হয় যা ৫ বছরের ওপর শরীরে মধ্য রেখে দেয়া যায়। ৩ দিনের আগে চামড়ায় তলায় ক্যাথেটার ঢোকানোর দরকার লাগে না।
ইনসুলিন পাম্পের ব্যবহার চিকিৎসা জগতে বিরাট সাফল্য। সব রকম চেষ্টায় যখন ডায়াবেটিসকে বাগে আনা যায় না, তখন ইনসুলিন পাম্প একমাত্র রক্ষাকর্তা। অত্যধিক পাম্পের দাম ও প্রতিদিনের খরচ পাম্প ব্যবহার একমাত্র বাধা। বিজ্ঞানের গবেষণা হয়তো ভবিষ্যতে কম দামে আমাদের এক আদর্শ ইনসুলিন পাম্প উপহার দেবে এই আশা অবশ্য করা যায়।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়