বুধবার, ২৬শে এপ্রিল, ২০১৭ ইং ১৩ই বৈশাখ, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ

ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ায় পিছিয়ে নারীরা

AmaderBrahmanbaria.COM
এপ্রিল ২৩, ২০১৭

নিউজ ডেস্ক : জাতীয় শিল্পনীতি-২০১৬ অনুযায়ী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে কমপক্ষে ১৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে ঋণ বিতরণ করতে হবে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখা যায়, ২০১৬ সালে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে (এসএমই) ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যে ঋণ বিতরণ করেছে, তার মধ্যে নারীরা পেয়েছেন মাত্র ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়, তা হচ্ছে হয়রানি। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঋণের বিষয়ে অজ্ঞতা বা ভীতিও কাজ করে নারীদের মাঝে। এই পরিস্থিতিতে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য কিছু নীতি-সমর্থন ও বাড়তি সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬ সালে এসএমই খাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ১ লাখ ৪১ হাজার ৯৩৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। যা ২০১৫ সালের তুলনায় ২৬ হাজার ৬৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা বা ২২ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেশি। ২০১৬ সালের জন্য নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বিতরণের হার ১২৫ দশমিক ০৫ শতাংশ। তবে এ ঋণের মধ্যে নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে গিয়েছে ৫ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, গত বছর ৪১ হাজার ৬৭৫ জন নারী উদ্যোক্তা ঋণ পেয়েছেন। টাকার অঙ্কে নারী উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিতরণ করা ঋণের হার আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে, ২৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ। তবে মোট বিতরণ করা ঋণের মাত্র ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ পেয়েছেন নারীরা। এ ছাড়া ২০১৬ সালে সামগ্রিকভাবে এসএমই খাতে ঋণ বিতরণ বাড়লেও ঋণপ্রাপ্ত নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা কমেছে ৭৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। ২০১৫ সালে মোট নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৮৮ হাজার ২৩৩।

নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। এসব ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর অনাগ্রহ যেমন রয়েছে, তেমনি নারীদের অজ্ঞতাও লক্ষ করা যায়। কেন নারী উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমছে, জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, অনেক ক্ষেত্রে ঋণ নিতে এত বেশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বা কাগজপত্র দেখাতে হয় যে তা হয়রানির পর্যায়ে চলে যায়।

বিজ্ঞাপনী সংস্থা অ্যাডকম লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী বলেন, অনেক নারী আসলে জানেনই না যে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করার মানসিক শক্তি তাঁরা অর্জন করতে পারেন না। এ ছাড়া হেনস্তার একটা বিষয় থাকে, ব্যাংকে কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে, এই সংযোগটি তৈরি হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন এসব বিষয়ে নজর দেওয়ার নির্দেশনা দিচ্ছে। তবে ঋণ নেওয়ার এই সচেতনতা বাড়াতে হবে। তিনি মনে করেন, একজন নারী ব্যবসা করছেন সমাজে, এই মানসিকতা তৈরি করা প্রয়োজন।

আর্থিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতার বিষয়ে অর্থনীতিবিদ সেলিম জাহান অতিসম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক আলোচনায় বলেন, নারী-পুরুষের মাঝে সমতা আনার ক্ষেত্রে সমান সুযোগের একটা বিষয় তোলা হয়। নারীরা শুরু থেকে অনেক বঞ্চিত হন। তাই শুরুতে তাঁদের সুবিধা না দিলে সমতা আনা কখনোই সম্ভব নয়।

২০১৬ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক এসএমই খাতে ঋণ বিতরণ করেছে ২২ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে নারীদের মাঝে বিতরণ করেছে ৬৭ কোটি টাকার ঋণ। সোনালী ব্যাংকের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ওই বছরে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৪৯ হাজার ৩১৭ কোটি টাকার। এই ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের মধ্যে ৬৮৩ কোটি টাকা পেয়েছেন নারীরা। জনতা ব্যাংক ঋণ বিতরণ করে ১০ হাজার ২৯৮ কোটি টাকার, যার মধ্যে নারীরা পেয়েছেন ৪৪৮ কোটি টাকা।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে যেমন ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড ২০১৬ সালে ঋণ বিতরণ করে ৭৩ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। তার মধ্যে নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে ১৫১ কোটি টাকা। ব্যাংক এশিয়া লিমিটেড বিতরণ করেছে সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ, নারী উদ্যোক্তারা এর মধ্যে পেয়েছেন ৬ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে আইএফআইসি ব্যাংক লিমিটেডের ১২ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা বিতরণ করা ঋণের মধ্যে ৬৩ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছেন নারী উদ্যোক্তারা।

অনলাইন প্রতিষ্ঠান গুটিপার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তাসলিমা মিজি বলেন ঋণ পেতে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। তিনি বলেন, ব্যবসার শুরুর দিকে একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নেন তিনি। ঋণ পেলেও প্রথমে তাঁর আবেদন নাকচ করা হয়। তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমে আমার ফাইলটা ফেরত পাঠিয়ে দেয় ওরা। তারা ঋণ দিতেই চায় না। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের আদেশের কথা বললাম। তারা তখন বলে মেয়াদ নেই, আরও নানা অজুহাত দেখিয়ে ফাইল ফেরত পাঠায়। পরে ওই ব্যাংকেরই এক উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাকে দিয়ে বারবার বলিয়ে ফাইলটার কাজ শুরু করা হয়। রি-পেমেন্টসের ব্যাপারে তাদের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। এরপর আমার ফাইল ওরা আবার রিভিউ করে।’

তাসলিমা মিজি বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের এই রক্ষণশীল আচরণ নারীদের পিছিয়ে দেয়। তারা অনেক বেশি কঠিন করে ফেলে ঋণের প্রক্রিয়াটি। আমি হয়রানির শিকার হয়েছি। এমন অনেক নারীই হচ্ছেন। সরকার থেকে অনেক নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবিক ক্ষেত্রে ঋণ নেওয়ার বিষয়টি নারীদের জন্য খুব বেশি সহজ হয় না।’

এ ক্ষেত্রে ঋণ সময়মতো পরিশোধ না করে সুনাম ক্ষুণ্ন করার বিষয়টি কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান করে। যে কারণেই ঋণের বিষয়টি জটিল হয়ে পড়ে বলে মনে করেন তিনি।

তবে নারী উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান কমার পেছনে কারণ হিসেবে বিপণনব্যবস্থার অদক্ষতাকে কারণ বলে মনে করেন লেদার কেইভের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তানিয়া ওয়াহাব। তিনি বলেন, ব্যাংকিং ক্ষেত্রে ঋণ নিতে কোনো ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হননি তিনি। তবে প্রচলিত ধারণা হলো, নারী উদ্যোক্তারা ব্যবসা শুরু করলেও বিপণনব্যবস্থায় দুর্বলতার কারণে এগিয়ে নিতে পারেন না। বাজারে কোনো কারণে ধস নামলে তাঁরা তা অনেক ক্ষেত্রে মোকাবিলা করতে পারেন না। তাই নতুন উদ্যোক্তা এগিয়ে আসছেন না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে এখনো নারীরা পিছিয়ে রয়েছেন। দেশে ৪২ হাজারের বেশি কলকারখানা থাকলেও মাত্র ২ হাজার ১৭৭টি ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ কারখানার মালিক নারী। প্রথম আলো

এ জাতীয় আরও খবর